১৩৩৭ বঙ্গাব্দ। মাঘ মাসের একটি দিন। সেদিন হাওড়ার নাকোল গ্রামের আকাশে উপচে পড়া আলো। আলোর বৃত্তে পূর্ণচাঁদের মায়া। সেই মায়ার লগ্নে জন্ম হয়েছিল যে ছেলেটির, তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল, 'পূর্ণেন্দু শেখর পত্রী'। যিনি উত্তরকালে প্রচ্ছদশিল্পী, কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, চলচ্চিত্রকার হিসেবে আদৃত হয়েছিলেন; প্রিয় হয়েছিলেন 'পূর্ণেন্দু পত্রী' নামে।
পূর্ণেন্দু শিল্পীসত্তার উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন মা নির্মলার কাছ থেকে। নির্মলা সেকালের মেয়ে। পড়াশুনোর তেমন সুযোগ পাননি। কিন্তু তাঁর হাতের কাজ ছিল একেবারে খাসা। সাধের আসন, নকশি কাঁথা, গয়না বড়ি, আলপনা, উলের কাজ, মুখে মুখে ছড়া কাটায় তাঁর জুড়ি ছিল না। সুন্দরকে আরও সুন্দর করে তোলাতেই ছিল তাঁর সাধনা। সাধনার এই উত্তরাধিকারও রক্তস্রোতে পেয়েছিলেন পূর্ণেন্দু।
পাড়ার বালকেরা যে বয়সে একত্র হয়ে গ্রাম্য খেলা খেলে চপলতা প্রদর্শন করে বেড়াত, সেই বয়সে পূর্ণেন্দু একলা একাই আপন মনে বাড়ির বাগানে বসে মাটি দিয়ে নানান পুতুল গড়ে আনন্দ যাপন করতেন। পুজোর সময় পাড়ায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক যাত্রাশালে শিল্পীদের পোশাক থেকে ঝরে পড়া চুমকি কুড়িয়ে এনে সাজিয়ে তুলতেন তাঁর সেই সাধের পুতুলগুলির অঙ্গ। নিষ্ঠা আর পরিশ্রমে কোন খামতি তাঁর ছিল না। তিনি আর-পাঁচজনের মতোই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর প্রবৃত্তি আর-পাঁচজনের মতো সাধারণ ছিল না মোটেই।
অবশ্য এই বিশেষ-প্রবৃত্তি প্রস্ফুটিত হবার অনেক আগে থেকেই কাকা নিকুঞ্জ পত্রীর আদরের দুলাল ছিলেন পূর্ণেন্দু। কাকা (এবং পরিবারের অন্যরাও) তাঁকে 'দুলাল' নামেই ডাকতেন। বলা বাহুল্য, কাকা তাঁর আদরের ভাইপোটির শিল্পীসত্তার দারুণ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাই পূর্ণেন্দু হাইস্কুলের পাঠ শেষ করতে-না-করতেই তাঁকে কলকাতায় নিজের কাছে এনে ইন্ডিয়ান আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।
কলকাতার নন্দরাম স্ট্রিটের বাসায় নিকুঞ্জ একাই থাকতেন। "দীপালি" নামের একটি সিনেমা বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকায় তিনি স্বল্প মাইনের চাকরি করতেন। স্বপাক ভোজনে অতিবাহিত করতেন কুড়োনো-বাড়ানো কষ্টের জীবন। কাকা কাজে যেতেন, আর শতরঞ্জিতে বসে সারাদিন ক্লান্তিহীন আঁকাজোকায় মাততেন পূর্ণেন্দু।
ইন্ডিয়ান আর্ট স্কুলের শিক্ষা তাঁর সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি নিজেই একদা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঝুঁকে পড়েছিলেন কাকার সঙ্গে পত্রিকার পৃষ্ঠাসজ্জা ও অলঙ্করণের কাজে। কেননা, এই সময় কাকা 'দীপালি'র কাজ ছেড়ে নিজেই 'চিত্রিতা' নামে একটি সিনেমার মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করতে শুরু করেছিলেন।
পূর্ণেন্দুর জীবনে শুরু হয়েছিল আঁকাজোকার মেলায় আর-এক অধ্যবসায়ের অধ্যায়। এগিয়ে চলেছিল স্বশিক্ষার পাঠ। এই সময় সিগনেট প্রেস প্রকাশিত পুস্তকমালার মাধ্যমে দিলীপ গুপ্ত এবং সত্যজিৎ রায়ের যুগলবন্দি বাংলা প্রকাশনা জগতে অক্ষরের ছাঁদ ও প্রচ্ছদ শিল্পে যে যুগান্তর এনেছিল, তাতে তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে তাঁর আধার হয়েছিলেন মা। জীবনে প্রথম প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে তাই মায়ের একটি নকশি কাঁথার শরণ নিয়েছিলেন। আসলে, কাকার পত্রিকার জন্য কাজ করতে করতেই প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে তাঁর একটু একটু করে শিল্পী-সাহিত্যিক মহলে ছড়াতে শুরু করেছিল।
কাকার পত্রিকায় শুধু যে তাঁর অলংকরণ প্রকাশিত হত তাই নয়, নিয়মিত কবিতাও প্রকাশিত হত। আসলে, ছড়া কাটা বা পদ্য রচনার স্বাভাবিক স্ফূর্তিও তিনি পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে, উত্তরাধিকারে। হাওড়ার বিভিন্ন আঞ্চলিক পত্রিকায় বাল্যেই তাঁর কবিতা প্রকাশের সূত্রপাত ঘটে গিয়েছিল। তারপর জীবনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অন্ত্যমিলের বাঁকবদল পেরিয়ে তাঁর কবিতার গড়ন ও বয়ান বদলে যেতে শুরু করেছিল। হয়ে উঠতে শুরু করেছিল তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর। আর তখনই তিনি প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে। কাব্যের নাম, 'একমুঠো রোদ'। এই কাব্যের প্রচ্ছদশিল্পীও ছিলেন তিনি নিজে।
প্রচ্ছদ শিল্প-কবিতার ভুবনে তিনি যখন মগ্ন সাধক, তখন "উল্টোরথ" পত্রিকায় ঘোষিত হয়েছিল সাহিত্য প্রতিযোগিতার কথা। তাতে তাঁর বেশ কৌতূহল হয়েছিল। আগ্রহ জেগেছিল। অবিলম্বেই প্রতিযোগিতার জন্য লিখে ফেলেছিলেন আস্ত একখানা উপন্যাস। 'দাঁড়ের ময়না'। কবির হাতে গড়ে উঠেছিল অসাধারণ গদ্যের মায়া। রচিত হয়েছিল অপূর্ব কাহিনি। সেই মায়াময় কাহিনি এনে দিয়েছিল দ্বিতীয় পুরস্কার। রুপোর পদক। পূর্ণেন্দুর জীবনে এভাবেই সূচিত হয়ে গিয়েছিল কথাকারের জয়যাত্রা।
বাংলা সিনেমায় দিকবদল ঘটিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের "পথের পাঁচালী"। সেই ছবি দেখে বিহ্বল হয়েছিলেন পূর্ণেন্দু। বিভূতিভূষণ রচিত কাহিনির এমন চমৎকার চিত্রায়ণ তাঁকে দারুণভাবে প্রাণিত করেছিল। শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্রের কৃৎকৌশল শিখতে। সম্পাদনার হালহকিকত বুঝতে। তারপর প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার' ছোটগল্প অবলম্বনে লিখে ফেলেছিলেন চিত্রনাট্য। শিল্প-নির্দেশনার দায়িত্বও আপন কাঁধে নিয়ে বাবা-কাকা ও নিজের জমানো টাকা সম্বল করে শুরু করে দিয়েছিলেন শ্যুটিং। তৈরি হয়েছিল 'স্বপ্ন নিয়ে' ছবিটি।
'স্বপ্ন নিয়ে' যদিও দু'সপ্তাহের বেশি চলেনি, ছবিটি যদিও ব্যবসা করতে ব্যর্থ হয়েছিল; অনেক কারিগরি ত্রুটির কথা বলে তবুও সমালোচকেরা সে-সময় একবাক্যে স্বীকার করেছিলেন যে, ছবিটিতে ফ্রেমিং এবং স্টোরি-টেলিং-এর ক্ষেত্রে অনেক নিরীক্ষার পরিচয় আছে, যা এ-যাবৎ দেখা যায়নি।
পূর্ণেন্দুর প্রথম ছবি শুধু তো ব্যর্থ হয়নি, তাঁকে আর্থিক সংকটের মুখেও ঠেলে দিয়েছিল। তবু এই ব্যর্থতা তাঁকে দমিয়ে দিতে পারেনি। নিজের কারিগরি ভুলগুলো শোধরানোর অভূতপূর্ব স্পৃহা তাঁর মধ্যে ছিল। তাই প্রথম ছবিটি যতদিন হলে চলেছে, তিনি নিয়ম করে প্রতিটি শো দেখেছেন, ভুলগুলো মার্ক করেছেন। শোধরানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন অবিরত।
ছবি করতে গিয়ে পূর্ণেন্দু বুঝেছিলেন যে, তিনি যে ধরণের ছবি করতে চান, সঙ্গীত সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না-থাকলে সেই ধরণের ছবিতে মনোমত কাজ করা যাবে না। তাই অবিলম্বে সঙ্গীতে তালিম নিতে শুরু করেছিলেন শ্রদ্ধেয় সুবিনয় রায়ের স্কুলে। এবং তালিম-ঋদ্ধ হয়ে অচিরেই আপন ছবির সঙ্গীত পরিচালকও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এমনই ছিল তাঁর শেখার আগ্রহ, এমনই ছিল তাঁর প্রতিভা।
এমনতর প্রতিভাবান শিল্পী হয়েও সমসময়ে প্রকৃত সম্মান কিন্তু পূর্ণেন্দু পাননি। তাঁর ছায়াছবি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি, এমনকি প্রকাশকদের মধ্যে তেমন দেখা যায়নি তাঁর পুস্তক প্রকাশের আগ্রহও। কেবল তাঁর একটি সত্তাকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারেনি, সেটা হল তাঁর 'প্রচ্ছদ-শিল্পী'সত্তা। অসংখ্য বই শুধুমাত্র তাঁর প্রচ্ছদের জোরেই দিনের পর দিন বিক্রি হয়েছে, এমন পরিসংখ্যান বইপাড়ায় রয়েছে। অবশ্য প্রচ্ছদশিল্পে তাঁর অবদান যতটা, ততটা নিয়েও আলোচনা হয়নি। তবু তারই মাঝে তাঁর একটি গুণমুগ্ধ পাঠক ও দর্শকশ্রেণি রয়েছে। যাঁরা তাঁর 'ছেঁড়া তমসুক', 'মালঞ্চ'-এ মুগ্ধ, 'দাঁড়ের ময়না', 'কথোপকথন', কলকাতা-গ্রন্থাবলীতে ঋদ্ধ, তাঁর প্রচ্ছদ সম্বলিত পুস্তক-অভিলাষী। তাই সমস্ত উপেক্ষার মাঝেও ভবিতব্যের পথে সেই তাঁদের মধ্যেই পূর্ণেন্দু বেঁচে থাকবেন বহুকাল, এ-বিশ্বাস আমাদের আছে...