দাদা পূর্ণেন্দু খাস্তগির চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য্য সেনের বিপ্লবী দলের ঘনিষ্ঠ। দলের সদস্যরা কেউ ধরা পড়লে তাদের নিষিদ্ধ বইপত্র রেখে যেত তার এক বোনের কাছে। তাকে কখনও বলতেন না বইয়ের আসল ইতিহাস। মেয়েটি যেন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে আঁচ করতে পারত। সেই সমস্ত আগুনে বই লুকিয়ে রেখে দিত মায়ের পুরনো বাতিল বাক্সের নিচে। মাঝরাত গড়ালে বাড়ির সবাই যখন ঘুমে কাদা সে সেইসব বই পত্র খুলে বসত। পরবর্তী সময়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে রক্তের দাগে লেখা হয়েছিল তার নাম। ভারতের প্রথম মহিলা শহীদ। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ডাক নাম রাণী।
চট্টগ্রাম পুরসভার প্ৰধান করনিক জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং প্রতিভাময়ী ওয়াদ্দেদারের ছয় সন্তানের মধ্যে প্রীতিলতা দ্বিতীয়। ছোটবেলা থেকেই সে অন্যরকম। বাকিদের চেয়ে আলাদা। ঝকঝকে মেধাবী। বুদ্ধির দীপ্তিতে উজ্জ্বল চোখ। চট্টগ্রামের প্রকৃতির মতই তার স্বভাব। পাহাড়ের মতো কঠিন। আবার আকাশের মতো খোলামেলা। উদার।
সময় তখন উত্তপ্ত। বিপ্লবের গন্ধে ভারি চট্টগ্রামের বাতাস। সেই গন্ধ আচ্ছন্ন করে রানীকে। অস্থির হয়ে ওঠে সে। দেশের মানুষের অসহায়তায় কষ্ট পায়। রাগে ছটফট করে উঠে। উল্টে-পাল্টে বদলে দিতে ইচ্ছে করে চারপাশটা। পারে না।
দাদা পূর্ণেন্দুর কাছে জানতে চায়। তিনি বইপত্র দিয়ে যান। মেধাবী প্রীতিলতা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বৃত্তি নিয়ে পাশ করেন। তারপর ঢাকার ইডেন স্কুলে। ইন্টার মিডিয়েট পাশ করে দর্শন নিয়ে পড়তে ভর্তি হন বেথুন কলেজে।
এদিকে ক্লাসের সেরা ছাত্রীটিকে দেশ টানছে। চোখের ওপর ঘটে যাওয়া প্রতিটা কর্মকান্ড ভাবাত। আক্রান্ত দেশের তথ্য ছিল নখ দর্পণে। আবেগের পাশাপাশি শান দিচ্ছিলেন যুক্তি চিন্তার ধারে।
দাদাকে ধরলেন, বিপ্লবী দলে যোগ দিতে চান। নাছোড়বান্দা আবদার!
মাস্টারদাকে জানানো হল প্রীতিলতার কথা। কিন্তু মাস্টারদা রাজি নন। অস্ত্র, গোলা বারুদ, রুদ্ধশ্বাস অনিশ্চয়তার কঠিন পথ। কোমলমতি মেয়েরা সেসবের উপযুক্ত নয়! তারা সাহায্যকারী হতে পারে, সহযোদ্ধা নয়। বিএ পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা চলে এলেন চট্টগ্রামে। উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হয়ে। অনেক চেষ্টার পর দেখা হল মাস্টারদার সঙ্গে। সাত দিনের ছুটিতে প্রীতিলতা পিস্তল চালনা, শরীর চর্চা, অধ্যবসায় দেখে দল তার ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হল।
এর মধ্যেই ঘটল ধলঘাটের ঘটনা। এক রাতে পুলিশ তাদের গোপন বাসস্থান ঘিরে ফেলল। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিলেন দুই সদস্য। গোলাগুলির মধ্যে দিয়েই মাস্টার দা, প্রীতিলতা আর অন্য রা অন্য আশ্রয়ের জন্য অন্ধকারে চলতে শুরু করলেন। শুরু হলো প্রীতিলতার আত্মগোপনের পালা। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে। জীবিত বা মৃত প্রীতিলতার জন্য ৫০ হাজার টাকার ইনামও ঘোষণা করেছে পুলিশ।
আত্মগোপন অবস্থাতেই প্রীতিলতা বিপ্লবীদের কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন তিনি। আবার নতুন অভিযান। ইউরোপিয়ান ক্লাব অভিযানে নেত্রী মনোনীত হলেন। সেই ক্লাবের সামনের ফলকে লেখা ছিল ‘ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস নট অ্যালাউড’— অভিযান দুবার ব্যর্থ হয়েছিল। তৃতীয়বারের অভিযানে প্রীতিলতার নেতৃত্বে সচেতন বিপ্লবী যারা অনেকেই ছিলেন জালালাবাদ যুদ্ধের যোদ্ধা।
নিপুণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাত। বাবুর্চির বেশে বিপ্লবী যোগেশ মজুমদার। তাঁর সংকেত দিলে অধিনায়িকা প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন।
প্রীতিলতার নেতৃত্বে মাস্টার দার অভিযান সফল হল। মালকোঁচা মারা ধুতি, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি আর ব্যাজ লাগানো লাল শার্ট প্রীতিলতাকে মাস্টার দা নিজেই সাজিয়ে দিয়েছিলেন। গ্রেপ্তারি এড়াতে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে নেন।
২৪ সেপ্টেম্বরের অভিযানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর আগে মাস্টারদাকে প্রীতিলতা বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু ফিরে আসব না। কাউকে তো জীবন দিয়ে শুরু করতে হয় দাদা। বেথুন কলেজের ছাত্রী প্রীতিলতা আলীপুর জেলে বন্দী, ফাঁসির আসামি বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দলের হয়ে অন্তত চল্লিশবার দেখা করেছেন তার বোনের পরিচয়ে। প্রীতির জীবনে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের অধ্যায় বিপ্লবের আরও কঠিন স্তরে তার উত্তরণ ঘটায়। ছড়িয়ে দেয় বিপ্লবের গাঢ় রং তাঁর জীবনে।
হাসি-গান-তত্ত্বকথা হালকা কথার দিন প্রীতিলতার শেষ হলো রামকৃষ্ণের ফাঁসির সঙ্গে। সশস্ত্র বিপ্লবের পথে তিনি এবার সংকল্পবদ্ধ। সবার অনুরোধে বিএ পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা চলে এলেন চট্টগ্রামে। সংসারের সহায় হয়ে দাঁড়াল অপর্ণাচরণ উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হয়ে। কিন্তু প্রীতি এখন মরিয়া সূর্যসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বদৌলতে শেষ পর্যন্ত মাস্টার দার সম্মতিতে প্রীতিলতার জীবনে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেদিন ধলঘাটের গোপন আশ্রয়ে মাস্টারদার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হলো। সাত দিনের ছুটিতে প্রীতিলতা পিস্তল চালনা (দীপালি সংঘ থেকে শেখা) অন্যান্য শরীরচর্চা এবং বিপ্লবী জীবনের কঠিন অভ্যাসগুলো অনুশীলন করেন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। তার একাগ্রতা ও দৃঢ়তা অথচ হৃদয়ের কোমল স্পর্শি মাস্টার দা থেকে শুরু করে নির্মল সেন প্রমুখ সবাই মেয়েদের যোগ্যতা সম্পর্কে নিঃসংশয় হয়েছেন। কিন্তু ধলঘাট অধ্যায়ও শেষ হলো রক্তস্রোতে। এক রাতে পুলিশ তাদের গোপন বাসস্থান ঘিরে ফেলল। পুলিশ দোতলায় উঠে গুলি চালিয়ে নির্মল সেনকে হত্যা ফেলল। গোলাগুলির মধ্যে মাস্টার দা, প্রীতিলতা আর ভোলা অন্য আশ্রয়ের জন্য অন্ধকারে চলতে শুরু করলে ভোলাকে প্রাণ দিতে হলো। শুরু হলো প্রীতিলতার আত্মগোপনের পালা। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। জীবিত বা মৃত প্রীতিলতার জন্য ৫০ হাজার টাকার ইনামও ঘোষণা করেছে পুলিশ। আর সমাজে বিপ্লবী মেয়েদের সম্পর্কে ঘৃণা সৃষ্টির জন্য পুলিশ মেয়েদের চরিত্র হনন থেকে শারীরিক রূপ নিয়েও তখন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে ছাড়ত না।
আত্মগোপন অবস্থাতেই প্রীতিলতা বিপ্লবীদের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব অভিযানে অবিসংবাদী নেত্রী মনোনীত হলেন। ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনের ফলকে লেখা ছিল ‘ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস নট অ্যালাউড’—ইংরেজের এই বিদ্বেষ বিপ্লবীদের রক্তে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল। এই অভিযান দুবার ব্যর্থ হয়েছিল। তৃতীয়বারের অভিযানে প্রীতিলতার নেতৃত্বে সচেতন বিপ্লবী যারা অনেকেই ছিলেন জালালাবাদ যুদ্ধের যোদ্ধা, নিপুণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ব্রিটিশদের প্রমোদ ভবন উড়িয়ে দিতে তিন দিক থেকে আক্রমণ চালান। কথামতো বাবুর্চির বেশে যোগেশ মজুমদার সংকেত দিলে অধিনায়িকা প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আগ্রাসনের নির্দেশ দেন। মুহূর্তে প্রমোদ ভবন শ্মশানে পরিণত করে বিপ্লবীরা যেন হিজলী জেল ও জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেন। প্রত্যক্ষদর্শী বীরেশ্বর রায়ের তথ্য অনুযায়ী, ১২ জন ইউরোপীয় নিহত এবং ১১ জন আহত হন। যদিও মান বাঁচাতে পুলিশ একজন ইউরোপীয় মহিলার মৃত্যু দেখিয়ে অভিযানের প্রতিক্রিয়া লঘু করে রিপোর্ট দিয়েছে।
প্রীতিলতার নেতৃত্বে মাস্টার দার ছক কষা অভিযান সফল হলো অবশেষে। বীর সেনানীর মতো সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন শান্ত-সাহসী-দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রীতিলতা। পুরুষের মতো মালকোঁচা মারা ধুতি, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি আর ব্যাজ লাগানো লাল শার্ট প্রীতিলতাকে মাস্টার দা নিজেই সাজিয়ে দিয়েছিলেন। আর, প্রীতিলতা যে দেশের জন্য উৎসর্গ উন্মুখ, সে মাস্টার দার কাছ থেকে যেন অনুমতি নিয়ে নেন, আত্মদানের। হুইসেল বাজিয়ে প্রত্যেক সহযোদ্ধাকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে আদেশ দিয়ে অনিবার্য গ্রেপ্তারি এড়াতে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে নেন। নিজের শরীরে রেখে যান আগ্নেয়গিরির উত্তাপ ভরা বিপ্লবী অসাধারণ এক জবানবন্দি। ভারতবর্ষের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ ২১ বছরের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের দেশের জন্য প্রাণ দানের ইতিহাসে প্রীতিলতাই একমাত্র নারী নন। প্রীতিলতার বিপ্লবী হওয়ার প্রধান উদ্দেশ্যই নারী শক্তির সঠিক মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠা করা, যা তিনি প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন। ২৪ সেপ্টেম্বরের অভিযানের প্রাক মুহূর্তে মাস্টার দাকে প্রীতিলতা বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু ফিরে আসব না। কাউকে তো জীবন দিয়ে শুরু করতে হয় দাদা।