বাবা মহেশচন্দ্র আতর্থী ছিলেন এমনিতে নিতান্তই ভালোমানুষ, কিন্তু স্বভাবে অত্যন্ত রগচটা। প্রেমাঙ্কুর 'মহাস্থবির' ছদ্মনামে লেখা তাঁর অসামান্য আত্মজীবনী 'মহাস্থবির জাতক'-এ পরিবারের সবার ছদ্মনাম দিয়েছেন। সেখানে বাবার ছদ্মনামে রেখেছেন মহেশেরই নামান্তর, 'মহাদেব'। কেননা, মহেশ ছিলেন মহাদেবের মতোই চণ্ড। অসম্ভব মারকুটে মেজাজ, অবিরত মারমুখো হাত। ছেলেবেলায় কার না খুনসুটি করার ইচ্ছে হয়, কার না হয় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খানিক হুটোপাটি, দু'চাট্টে ছুটকো-ছাটকা মারপিট, কিংবা ধরুন পড়াশুনোয় ফাঁক দেখে ফাঁকি দেবার ইচ্ছে? প্রেমাঙ্কুরদের তিন ভাইয়েরও তাই হত। কিন্তু, এসব বাবার কানে উঠলেই তিরিক্ষে হয়ে সেই যে তিনি মারতে শুরু করতেন ছেলেদের আধমরা করে তবেই ছাড়তেন। কতবার মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে গেছেন প্রেমাঙ্কুর, ভলকে ভলকে মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছে। ফলে, প্রেমাঙ্কুর আর স্কুল শেষ করতে পারেননি। লোক বাঁচার জন্য ঘরে ফেরে, তিনি বাঁচার জন্য একদিন ঘর ছাড়লেন।
শুরু হল বারো-তেরো বছরের এক কিশোরের বোহেমিয়ান জীবন; বাঁচার জন্য অসম্ভব এক জীবন সংগ্রাম। বম্বের ফুটপাথে ভিখারিদের সঙ্গে লড়াই করে, তাদের বন্ধু হয়ে, জনমানবহীন জঙ্গলে বারো ঘন্টার দিনমজুরি করে, আধপেটা খেয়ে-না-খেয়ে, বড়লোকের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে, গৃহশিক্ষকতা করে--এক বিচিত্র জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি বড় হয়েছিলেন। কলকাতায় ফিরেও কখনো তিনি দোকানের কর্মী, কখনো বা সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক। এভাবেই দেখেছিলেন সমাজের ছোট থেকে বড় সমস্ত স্তর, সমস্ত শ্রেণির মানুষকে অত্যন্ত কাছ থেকে। সেই দেখা দেখতে গিয়ে শুধু উপলব্ধির স্তরগুলো খুলে গিয়েছিল। কিন্তু কাউকেই ঘৃণ্য বলে মনে হয়নি তাঁর। মরমী ও সংবেদনশীল মনটি বহুধা তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যেও জেগে ছিল বলেই হয়তো হয়নি। এইসব মিঠেতেতো অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্য ও শিল্পীজীবনের আকর হয়ে উঠেছিল। আঠাশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম গল্প-সংকলন, 'বাজীকর'। তারপর একে একে প্রকাশিত হল 'আনারকলি', 'ঝড়ের পাখী', 'চাষার মেয়ে', 'স্বর্গের চাবি'-প্রভৃতি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ।
পরবর্তীকালে নিছক গল্প-উপন্যাস লিখলেও ছেলেবেলায় কবিতাই লিখতেন প্রেমাঙ্কুর। তাঁর ছিল বাঁধানো একখানা কবিতার খাতা। বাড়ি ছাড়ার বেশ কিছুকাল আগেই তাঁর দীক্ষা হয়েছিল কবিতায়। দীক্ষা দিয়েছিলেন বাড়ির কাছেই আরেক বাড়িতে থাকা এক বৃদ্ধ। তিনি কোলরিজের কবিতা শোনাতেন। পড়ার বাইরে পড়ার অভ্যেস, বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে অবারিত জ্ঞান প্রেমাঙ্কুর পেলেন তাঁর কাছে। তাঁর কাছেই কবিতার ভাবলোকের সঙ্গেও আলাপ হল। কিন্তু, বয়সটি নেহাতই বালক। তাই, অহেতুক আবেগেও জোর কদমে ভর্তি হতে লাগল কবিতার খাতা।
সে-বার প্রতিবারের মতোই পুজোর সময় পরিবারের সঙ্গে দেওঘর বেড়াতে গেলেন প্রেমাঙ্কুর। দেওঘরে ছিল রাজনারায়ন বসুর বাড়ি। তাঁর ছেলে মনীন্দ্রনাথ বসু ছিলেন সেকালের একজন ডিটেকটিভ উপন্যাস-লেখক। তিনি আবার অত্যন্ত স্নেহ করতেন প্রেমাঙ্কুরকে। কতশত বিদেশি লেখকের গল্প শোনাতেন। তা, কথায় কথায় তিনি একদিন জানতে পারলেন, প্রেমাঙ্কুরের কবিতা-বাতিকের কথা। ফলে, আদেশ দিলেন দেওঘরের ওপর একখানা কবিতা লেখার। সে আর এমন কী! লিখে ফেললেন একখানা গুরুগম্ভীর কবিতা :
"সন্ধ্যা হইল
নন্দন পর্বত গুহে ব্যাঘ্র প্রবেশিল।
জীবজন্তু মানবাদি নিদ্রায় মগন
শর্বরী সঘন।"
বালক-কবির এমন গুরুগম্ভীর কবিতা পড়েও গম্ভীর থাকতে পারলেন না মনীন্দ্রনাথ। বেজায় হাসতে শুরু করলেন। বাঘ সন্ধ্যে হতেই গুহায় ঢুকে শুয়ে পড়বে কেন! সে কি সরকারি অফিসের কেরানি নাকি! প্রেমাঙ্কুর বুঝলেন, সত্যিই তো বাঘকে সন্ধ্যে সন্ধ্যে গুহায় ঢুকিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ঠিক কাজ হয়নি। তার তো তখনই শিকারে বেরোনোর কথা! এইসব সাতপাঁচ তিনি যখন ভাবছেন, তখন মনীন্দ্রনাথ তাঁকে বললেন, কবিতা ছেড়ে গল্প লিখতে। নন্দন পাহাড় নিয়েই। কিন্তু, ব্যাপারটা এবার কবিতার মতো চটজলদি এগোল না। কারণ, অনেক ভেবেও প্লট এলো না মাথায়। প্লটের ভাবনায় নাস্তানাবুদ হয়ে শেষমেশ শরনাপন্ন হলেন মনীন্দ্রনাথেরই। হ্যাঁ, তিনিই দিলেন প্লট। তাঁরই জীবনের এক সত্য ঘটনা।
নন্দন পাহাড়ের মাথায় তখন একটি ভাঙাঘর ছিল। তার সামনে আড্ডা দিতেন কিশোর মনীন্দ্রনাথ ও কয়েকজন ছেলে। সন্ধ্যের সময় একদিন হাত-পায়ের আঙুল পড়ে যাওয়া এক কুষ্ঠরোগিকে বুকে হেঁটে ও-পারের গ্রাম থেকে পাহাড়ের ওপর আসতে দেখলেন। সে দূরের কুষ্ঠ হাসপাতালে যেতে চায়। তেষ্টায় সে মৃতপ্রায়। তাকে জল খাইয়ে, ভাঙা ঘরটিতে শুইয়ে পরদিন সকালে ডুলিতে করে হাসপাতালে পৌঁছে দেবার আশ্বাস দিয়ে মনীন্দ্ররা চলে গেলেন। ভোর রাতে ডুলি নিয়ে এসে আবিষ্কার করলেন, অসহায় লোকটাকে জ্যান্ত শেয়ালে একেবারেই খেয়ে ফেলেছে, পড়ে আছে শুধু ক'খানা হাড়! এই মর্মান্তিক কাহিনি নিয়েই প্রেমাঙ্কুর লিখেছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম গল্প। কিন্তু, সে-গল্পের কী নাম ছিল, তা আর জানাননি তিনি।
প্রেমাঙ্কুর শুধু সাহিত্যিকই ছিলেন না। ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের সবাক বাংলা ছবি পরিচালনার কৃতিত্ব তাঁর। ছবির নাম, 'দেনাপাওনা'। তাছাড়াও 'কপালকুণ্ডলা', 'দিকশূল', ' ইহুদী কে লেড়কী'-র মতো সেকালের বিখ্যাত ছবিগুলো তাঁরই পরিচালনা। এছাড়া, জয়গোপাল পিলে'র পরিচালনায় 'পুনর্জন্ম' ছবিতে রেখেছিলেন তাঁর অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষরও।
সংগ্রামী জীবনের বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠা প্রেমাঙ্কুর ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নির্ভেজাল রসিক, নিখুঁত আড্ডাবাজ, নিপাট ভদ্রলোক এবং ছেলেবুড়ো সবার প্রিয়, 'বুড়োদা'।
তথ্যঋণ : 'মহাস্থবির জাতক' - মহাস্থবির; 'গল্প লেখার গল্প'- জ্যোতিপ্রসাদ বসু।