হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে এক কথায় জানিয়েছিলেন, তাঁর প্রিয় গায়িকা 'প্রতিমা'। তাঁর কথায় বাঁশরী কন্ঠি। গায়ের ওপর আঁচলখানা জড়িয়ে যখন গান গাইতে থাকেন মনে হয় পাথরের প্রতিমা।
জড়সড় চেহারা। তেল দিয়ে টেনে বাঁধা চুল, নাকে মুক্তোর নাকচাবি, গালের একদিকে পান। পানের রসে ভিজে চুপচুপে ঠোঁটদুটো গানের সময় কখন যে নড়ে বোঝা যায় না। আসলে তিনি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। গান যখন গান তখন মন্ত্র মুগ্ধ করে রাখেন দর্শকদের। তাদের আর নড়ার ক্ষমতা থাকে না। নির্ঝরিণী সুরের চলন চলে শুধু। স্থাণু মূর্তির মতো বসার ভঙ্গিতে সুরের ধারায় অবগাহনের টান। সে সময় কথা বলতে নেই।
অদ্ভুত মায়াঘোরে প্রতিমা গেয়ে যান, ' বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই, এমন সময় শোলোক বলা কাজলা দিদি কই'।
চোখের জলে বুক ভেসে যায় শ্রোতার। এ গানে বাঙালি না কেঁদে থাকতে পারে না। কবেকার শিকড়ের টান। মনের মধ্যে বুদ্বুবুদিয়ে ওঠে যন্ত্রণা। অথচ হারমনিয়ামের সামনে যিনি বসে আছেন তিনি অভিব্যক্তিহীন।
ব্যথার গান তাঁর গলায় এমন ভাবে কেন বাজত শ্রোতাদের জানা নেই। জানতেন না হয়ত তিনি নিজেও। তিনি কেবল খুঁজে চলতেন। সুরের পথে পাড়ি দিয়ে আত্ম অনুসন্ধান। একবার পুজোর রেকর্ডে গাইলেন, ' বড় সাধ জাগে, একবার তোমায় দেখি'। কথা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রেমের গান। কিন্তু অন্য আবেদন নিয়ে ধরা দিল। যেন গুমরে থাকা এত দিনের না দেখা সব যন্ত্রণারা এক সঙ্গে কথা বলে উঠেছে। এই গানের টান থেকে আজও বেরতে পারেনি মানুষ। সেই সৃষ্টি ছাড়া হাহাকার আজও ঘিরে রেখেছে শ্রোতাকে একই আবেগে।
জীবনকে খুব উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে সাধিকার সাধন আছে, মায়া আছে কিন্তু দমবন্ধ মোহ নেই। তাই গানের দুনিয়ার নক্ষত্র হয়েও তিনি খোলামেলা, সহজ সরল। জাগতিক জীবনে থেকেও আপন গহনে ডুব দিয়ে থাকতে জানতেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জোরাজুরিতে বম্বে গিয়েছিলেন। গান গেয়েছিলেন 'সাহারা' ছবিতে। মীনাকুমারীর লিপে। জনপ্রিয় হয় গান। কিন্তু তিনি ফিরে এসেছিলেন কলকাতাতেই।
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্ম দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরে। ১৯৩৪ এর ২১ ডিসেম্বর। বাবা মণিভূষন চট্টোপাধ্যায়। গান পাগল, ফুটবল পাগল মানুষ। তাঁর গান ডানা মেলেছিল ছোট্ট প্রতিমার ভিতরেও। মায়ের ইচ্ছেতে গান শেখার শুরু। প্রথম গুরু প্রকাশকালী ঘোষাল। পরবর্তী সময়ে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়।
খুব ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। গানের ক্ষেত্রে বিবাহিত জীবন কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং স্বামীর অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে তাঁর গানের জগতে প্রবেশ।
প্রথম প্লেব্যাক ' সুনন্দার বিয়ে' ছবিতে। ছবির সঙ্গীত পরিচালক তাঁকে আবিষ্কার করেছিলেন এক গানের অনুষ্ঠানে।
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের মধ্যে আত্মনিবেদনের ভঙ্গিটি সব বয়সের মানুষকে বড় টানত। ওই ভঙ্গির মধ্যে দিয়েই যেন মানুষটাকে আবিষ্কার করা হয়ে যায়। গান, জীবন আর বেঁচে থাকার দর্শনটা যাঁর কাছে একই। কোথাও কোনও বিচ্যুতি নেই।
স্বামী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গানজীবনের প্রেরণা ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে ভীষন ভেঙে পড়েছিলেন। তার পর থেকেই ক্রমশ সরে আসেন মঞ্চ, প্লেব্যাক, রেকর্ডের দুনিয়া থেকে। শরীর ভেঙে পড়ে। কিন্তু শিরায় ধমনীতে যাঁর গান তিনি গান থেকে দূরে থাকবেন কী করে! শেষ জীবন পর্যন্ত গানের প্রতিমাই হয়ে ছিলেন তিনি।