প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হয়েছিলেন, ছোট্টবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী, ইচ্ছে ছিল বিদেশে গিয়ে আরও পড়বেন। মায়ের আপত্তিতে সে যাত্রায় আর বিদেশ যাওয়া হল না। তিনি হয়ে উঠলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষ! তিনি প্রমথেশ বড়ুয়া।
কলেজে পড়াকালীন শিশির ভাদুড়ীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রমথেশ, ছাত্রাবস্থায় বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করে ফেলেছিলেন ‘ইয়ং ম্যানস ড্রামাটিক ক্লাব’। এই ক্লাবের সদস্যদের নিয়েই করেছিলেন, নূরজাহান, কারাগার, প্রফুল্ল, ষোড়শী, বিবাহবিভ্রাট ইত্যাদি নাটক। তবে পরিচালনা করেই ক্ষান্ত হতেন না, অভিনয়ও করতেন। সেই সঙ্গে চলত খেলাধুলো। ছোট্টবেলা থেকেই তাঁর ছিল শিকারের নেশা। শিকার তাঁদের পরিবারিক ঐতিহ্যও বটে। এই শিকারের নেশাই তাঁকে টেনে নিয়ে গেল অভিনয়ে।
তখন নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ,১৯২৯ নাগাদ ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়, দেবকীকুমার বসু, নীতীশ লাহিড়ী প্রমুখের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ ডমিনিয়নস ফিল্ম কোম্পানি, এঁদের প্রথম ছবি ছিল 'পঞ্চশর'। ঐ ছবি পরিচালনা করেছিলেন দেবকী বসু। ধীরেনবাবুর ডাকেই শুটিং দেখতে এসেছিলেন প্রমথেশ। দৃশ্যটি ছিল নায়িকাকে পাশে নিয়ে নায়ক বন্দুক ছুড়বে। কিন্তু নায়ক কিছুতেই বন্দুকটা ঠিক মতো ধরতে পারছেন না। ভুলটা বাকিরা ধরতেও পারছেন না। প্রমথেশ লক্ষ্য করলেন, নেশায় তো শিকারি আবার রক্তেও শিকার। কাজেই আর না পেরে বলেই বসলেন, নায়ককে ট্রিগার ধরার কায়দাকানুনও শিখিয়ে দিলেন।
তখন পরিচালক ওই দৃশ্যে নায়কের বদলে প্রমথেশকেই অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন। শুরু হল প্রমথেশের ফিল্মযাত্রা।
ব্রিটিশ ডমিনিয়নের পরের ছবি ‘টাকায় কি না হয়’ - ছবিতে অভিনেতা প্রমথেশের আত্মপ্রকাশ ঘটল। ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। নায়িকা সবিতা দেবী ওরফে আইরিশ গ্যাসপারের সঙ্গে গাড়িতে যেতে যেতে অন্তরঙ্গ হওয়ার মুহূর্ত ছিল ঐ দৃশ্যে। গাড়ির চালকের ভূমিকায় ছিলেন প্রমথেশের বন্ধু নির্মল বরকাকতি। কিন্তু ছোট্ট এই একটা দৃশ্য, সাত দিনেও টেক হল না! পরিচালক পড়লেন মহাবিপদে। কিন্তু কেন যে হচ্ছে না, তা ড্রাইভারের সিটে বসেই বেশ বুঝে ফেলেছিলেন নির্মলবাবু। আসলে নায়ক নায়িকার মধ্যে ক্রমেই গড়ে উঠেছিল ঘনিষ্ঠতা।
১৯৩০ সালে যকৃতের পাথরের চিকিৎসা করাতে ইউরোপ যাত্রা করলেন তিনি। ওখানে গিয়েই ফিল্ম কোম্পানি তৈরির ভূতটা মাথায় চেপে বসল। ফিল্ম মেকিং শিখতে হবে। সে সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপে, তাঁকে গিয়ে ধরলেন প্রমথেশ। ফ্রান্সে রবীন্দ্রনাথের চিঠি নিয়ে প্রখ্যাত ক্যামেরাম্যান রজার্সের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি। উদ্দেশ্য একটাই, হাতেকলমে ফিল্ম মেকিং শিখবেন। রজার্সের কাছে সিনেমায় কৃত্রিম আলোর ব্যবহার শিখলেন। যা তখনও ভারতীয় সিনেমায় অজানা। শুটিং-এর জন্য নানান রকম আলো ও অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনে কলকাতায় ফিরলেন তিনি। তখন এখানে দিনের বেলাতেই শুটিং হত।
ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে প্রমথেশ ‘বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট’ তৈরি করেন। সঙ্গে নিলেন পরিচালক দেবকী বসু ও ক্যামেরাম্যান কৃষ্ণগোপালকে। প্রথম ছবিটি ছিল নির্বাক ছবি। নাম 'অপরাধী', কাহিনি ও পরিচালনায় দেবকী বসু। অভিনয়ে প্রমথেশ, রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং সেই আইরিশ গ্যাসপার! বাংলা চলচ্চিত্রে সেই প্রথম কৃত্রিম আলোর ব্যবহার। চিত্রা টকিজে ২৮ নভেম্বর, ১৯৩১ সালে মুক্তি পেল সে ছবি। বসুমতী পত্রিকায় ছবির রিভিউ বেরোলো, প্রশংসায় এক্কেবারে পঞ্চমুখ।
এরপরে আরও দুটি নির্বাক ছবি, 'একদা' এবং 'নিশির ডাক'। কাহিনিকার প্রমথেশ বড়ুয়া স্বয়ং। ততদিনে কলকাতার গৌরীপুর হাউজের একটা অংশ নিয়ে তিনি শুরু করে দিয়েছেন বড়ুয়া স্টুডিয়োর কাজ। সেখানে একদা-র কিছু অংশ শুটিংও হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চাশ বছর পরে কোথায় দাঁড়াবে বাংলা ছবি, সেই অনাগত আগামী ভেবে লেখা নিজস্ব কল্পকাহিনি নিয়ে ছবি করলেন, 'বেঙ্গল নাইন্টিন এইট্টি থ্রি'। এই ছবি সুপারফ্লপ হল। এই সিনেমার জন্যে জলের মতো টাকা খরচ করছিলেন তিনি।
টাকা আসত গৌরীপুর রাজবাড়ির এসেস্ট থেকে, কিন্তু সেটাও বন্ধ হল। ছেলের এইভাবে টাকা ওড়ানো দেখে, গৌরীপুর এস্টেটের দেওয়ান প্রমথেশের বাবাকে সাবধান করেছিলেন। প্রথমে নিমরাজি থাকলেও, পরে দেওয়ানের কথাই মেনে নেন প্রমথেশের বাবা। কারণ তিনি তত দিনে বুঝে গিয়েছিলেন, ছেলের দ্বারা ব্যবসা হবে না। ফলে অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় বড়ুয়া ফিল্ম কোম্পানি। ভেঙে পড়েন প্রমথেশ। ১৯৩৩ সালে নিউ থিয়েটার্সে যোগ দিলেন তিনি। সেখানে তাঁর প্রথম সবাক ছবি 'রূপলেখা'। নায়িকা যমুনা দেবীর ডেবিউ ছবি এটি। এই ছবি থেকেই প্রমথেশ-যমুনার প্রেমপর্ব শুরু, পরে তাঁরা বিয়েও করেছিলেন।
১৯৩৫ সালে বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষাতেই প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালনা করলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দেবদাস'। বাংলায় দেবদাসের চরিত্রে তিনি আর পার্বতীর চরিত্রে যমুনা এবং হিন্দিতে 'দেবদাস' হলেন কে এল সায়গল। শুধু মাত্র প্রযুক্তিগত বিষয় নিয়েই নয়, শট নিয়েও বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন তিনি। ক্যামেরায় শট নেওয়ার ধরনধারণে বদল এল দেবদাস ছবিতে। সে সময় দাঁড়িয়ে 'দেবদাস' ছবিটি পরিচালনায় নিঃসন্দেহে বিপ্লব নিয়ে এসেছিল। চলন্ত ট্রেনের কামরায় উদভ্রান্ত দেবদাসের শট, দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করার ক্ষেত্রেও বদল নিয়ে এল দেবদাস।
মন্তাজ, ইন্টারকাটিং, ক্লোজআপ শট ব্যবহার করে সিনেমাকে করে তুললেন সিনেম্যাটিক। 'দেবদাস' ইতিহাস তৈরি করল। জনশ্রুতি রয়েছে পরবর্তীতে উত্তমকুমার দেবদাসের চরিত্রে অভিনয়ের অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কেবল প্রমথেশ বড়ুয়ার ইমেজ ভাঙতে পারবেন না বলে। কারণ এক সময় 'দেবদাস' মানেই হয়ে গিয়েছিল প্রমথেশ বড়ুয়া। ১৯৩৬ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া বানালেন 'গৃহদাহ' ও 'মায়া'। ছবি দুটো হিট করল। তারপরে আরেক ঐতিহাসিক সিনেমা মুক্তি মুক্তি পেল।
সেখানেও শট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট অব্যাহত থাকল। মুক্তিই হল প্রথম ছবি, যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছিল। অনুমতি দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ছবির নামকরণও তাঁর করা, গানটি প্লেব্যাক করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। মুক্তি সুপারহিট হয়েছিল, সেই সঙ্গে প্রমথেশ ও কাননদেবীর জুটিও ক্লিক করে গিয়েছিল। এরপরেই বানালেন 'অধিকার'। তার পর মাত্র ২১ দিনে শুটিং শেষ করেছিলেন কমেডি ছবি 'রজত জয়ন্তী'র। যা আজকের দিনে সম্ভব হলেও সেই সময়ে ছিল অষ্টম আশ্চর্য।
১৯৩৯ সালে নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে কে মুভিটোনের সঙ্গে চুক্তি বদ্ধ হলেন। এই ব্যানারে তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি ছিল 'শাপমুক্তি'। রবীন মজুমদার নায়ক আর নায়িকা ছিলেন পদ্মাদেবী, এই জুটিও সে সময় বেশ খ্যাতি পেয়েছিল। ১৯৪০-এ মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথ ভাবে গড়লেন এম পি প্রোডাকশন। এই হাউজের প্রথম ছবি 'মায়ের প্রাণ',পরের ছবি 'উত্তরায়ণ'। তারপর কানন দেবীকে নিয়ে বানালেন 'শেষ উত্তর', যা সে সময়ে ব্লকব্লাস্টার হিট! ঐ একই গল্প নিয়ে হিন্দিতে বানালেন জবাব।
'
কিন্তু এম পি প্রোডাকশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাঙল। এই সময় দু'বছর তিনি কোনও ছবিই করেননি। আবার পরিচালনায় ফিরলেন ১৯৪৪ সালে। তৈরি করলেন 'চাঁদের কলঙ্ক', ঐ একই গল্পে হিন্দিতে বানালেন 'সুবহ সাম'। শুটিং হয়েছিল ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে। এছাড়াও প্রমথেশ দুটি হিন্দি ছবি করলেন, 'আমীরী' এবং 'রানী'। বাংলা ছবি অগ্রগামীর পরে তিনি শুরু করলেন 'মায়াকানন', তাঁর জীবনের শেষ ছবি।
মায়াকানন-এর শুটিং শেষ হওয়ার আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রমথেশ। ১৯৪৮ সালে চিকিৎসার জন্য সুইৎজারল্যান্ড গিয়েছিলেন, রক্তাল্পতায় ভুগছিলেন। আরও চিকিৎসার দরকার, লন্ডন যাত্রা করলেন। কিন্তু তখনও তাঁর ধ্যানজ্ঞান কেবল ছবিই। এ জে আর্থার র্যাঙ্ক সংস্থার সঙ্গে ইন্দো-ব্রিটিশ ছবি পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিলেন কিন্তু তা আর হয়নি। ১৯৫১-তে চলে গেলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের রাজা প্রমথেশ বড়ুয়া। অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে তাঁর সাফল্য ঈর্ষনীয়। তিনি একা হাতেই স্বাবলম্বী করেছেন ভারতীয় চলচ্চিত্রকে, নির্বাক থেকে সবাক ছবির উত্তরণের কারিগরও তিনিই।