‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’
লেখা সম্পর্কে এই ছিল তাঁর ব্যক্তিগত মতামত। বাংলা ভাষা চর্চায় খোলা বাতাস আনতে বহুদিনের বন্ধ জানলাগুলো খুলে দিয়েছিলেন তিনি।
সম্রাট আকবরের দরবারে নবরত্ন সভার একজন ছিলেন বীরবল। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীও তেমনি এক রত্ন। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক।
জন্ম বাংলাদেশের যশোরে। বাড়ি পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামে।সেখানেই পূর্বপুরুষের বাস। পাঁচ বছর বয়সে যশোর ত্যাগ করে নদীয়া জেলায় চলে আসেন।
তাঁর নিজের অবশ্য ছোটবেলার স্মৃতিতে যশোরের কথা সেভাবে মনে পড়ে না। তাঁর ছোটবেলার গল্প শুরু হয় কৃষ্ণনগর থেকে। পরে শান্তিনিকেতনে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। তবু কৃষ্ণনগরের টান কখনও ফিকে হয়নি।
নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন, এই শহর তাঁকে ‘কনসাসলি’ ‘আনকনসাসলি’ অনেক কিছুই দিয়েছে। ক-খ, A-B-C ও শিখেছেন এই শহর থেকে।
কৃষ্ণনগরে এসে প্রথম মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। এক পাদরি আসতেন। প্রতিদিন সকালে খ্রিষ্টের ভজন হত। সঙ্গে খ্রিষ্ট ধর্ম নিয়ে বাংলায় বক্তৃতা। এক মাস পর বাবা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, স্কুল থেকে কী শিখেছে। উত্তর পেলেন আদম আর ইভের গল্প। বাবা রেগে লাল। তখন খুদে প্রমথ বলেন, স্কুলে ভজন শিখেছেন। গাইতে বললেন বাবা।
দুই ভাই মিলে গাইলেন,
বন্যে এসে ভেসে গেল, চাষার ডুবল ধান
শালাদের যেমন কর্ম তেমনি কর্মফল
তারপর থেকেই বন্ধ হয়ে গেল মিশনারি স্কুলে যাওয়া। ভর্তি হলেন ব্রজ বাবুর স্কুলে। স্কুলের নাম এ ভি স্কুল।
মাসখানেক পর বাবা প্রমথ আর তাঁর সেজ দাদাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কী পড়েছ’। উত্তর এল, ‘ জানোয়ারের ছবি দেখেছি’।
বাবা বললেন, ‘ আমি স্কুল ভেবে তোমাদের দেখছি এক চিড়িয়াখানায় পাঠিয়েছি’। পরদিনই ছেলেদের বের করে আনলেন সে ‘চিড়িয়াখানা’ থেকে।
শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। তবে স্কুলের ‘সেকেলে শিক্ষায়’ প্রমথের বিশেষ কোনও ভরসা ছিল না।
কৃষ্ণনগর তাঁকে বড় টানত। পাড়াগেঁয়ে শহর। শহরে টহল দিতেন। সব দোকানে আনাগোনা ছিল তাঁর। এমনকি গুলির আড্ডাতেও।
নৌকা চিনেছিলেন মালোপাড়া থেকে। মালোপাড়া মাঝি দের পাড়া।
প্রমথ চৌধুরী ভাষা শিখেছিলেন পথ চলতে চলতে, পাড়া বেড়াতে বেড়াতে। লোক মুখে শুনে। তাঁর কথায়, ‘সেকেলে নদে-শান্তিপুরের মৌখিক কথাও খুব শ্রুতিমধুর ছিল।‘
তাঁর বিশ্বাস ছিল নদীয়া-কৃষ্ণনগরের ভাষাই বাংলায় সর্ব শ্রেষ্ঠ বাংলা। তাঁর ভাষার বুনিয়াদ কৃষ্ণ নাগরিক বাংলা। প্রমথ চৌধুরীর মুখে ভাষা দিয়েছিল কৃষ্ণনগর। ফরাসীরা jeu de mots বলে যাকে সে খেলার চর্চা হত নদের শহরে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখাও কৃষ্ণনগরেই। প্রমথ চৌধুরীর দাদা এক জাহাজে তাঁর সঙ্গে মাদ্রাজ যান। সেই সূত্রেই বন্ধুত্ব। তাঁদের বাড়িতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
তাঁদের বাড়ির বারান্দায় বসে তাঁর দাদা আর রবীন্দ্রনাথ কথা বলছিলেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজ নিয়ে আলোচনা। তাঁদের কথা কানে এসেছিল কিশোর প্রমথের। তিনি একটি প্রশ্ন করেন দাদাকে।
পরে শুনেছিলেন, তাঁর প্রশ্ন শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোমার ও ভাইটি তো দেখছি অতি বুদ্ধিমান ও চতুর!’
প্রমথের প্রশ্নটি ছিল, ‘রাস্তা দিয়ে একটি ঘোড়া যদি সমান জোরে দৌড়ে যায়, তবে তার সমপদ বিক্ষেপের শব্দ কি কানে মিষ্টি লাগে না?যদিচ তার কোন সুরস্বর নেই, আছে শুধু সময়ের ব্যবধান।’
পাড়া গাঁয়ের এক কিশোরের মুখে এমন তিনি আশা করেননি। আর বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ বীরবলও সেই প্রথম আবিষ্কার করেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামের লোকত্তর মানুষটিকে।