‘সুনির্মল শর্মা’

সে বাড়িতে বাড়ি ভর্তি বই। ঘরের বাতাসে নতুন পত্রিকার গন্ধ। কান পাতলেই শোনা যায় এঘর-ওঘরে বইয়ের পাতা উল্টানোর আওয়াজ। বাড়ির ছোট থেকে বড় দিনশেষে সাহিত্যে মশগুল।

সে বাড়ির ছেলে যে জন্ম থেকেই ছন্দে-ছন্দে জীবনের পথ চলতে শিখবে সেটাই খুব চেনা স্বাভাবিক।

এই বাড়ির ঠিকানা গিরিডি। বর্তমানে ঝাড়খন্ডের মকৎপুর।  

সাইকেলের চাকা আর ঘন্টির আওয়াজ। ছন্দে বেঁধেছিলেন সে বাড়ির ছেলে। শিশুবোধের ছড়া। মুখে-মুখে ফিরত ছোট থেকে বড়োর।

ক্রিং-ক্রিং সাইকেল সবে সরে যাও না-  

চড়েতেছি সাইকেল দেখিতে কি পাও না?

এই ছড়া লিখেছিলেন স্কুলের পত্রিকায়। হারিয়ে যেতেই পারত লাইনগুলো। কিন্তু ছন্দের যাদুর এমনই টান যে সেই ছড়া এখনও বাঙালির ছোটবেলার সুর।

বাংলা সাহিত্যের এক জীবন্ত অধ্যায় তিনি।‘ছড়াকার’ কবি সুনির্মল বসু।

প্রথম নাম অবশ্য রাখা হয়েছিল ‘নির্মলচন্দ্র’। মাঝরাত্তিরে জন্ম। আঁতুড়ঘরের বিছানায় উথোল জ্যোৎস্নার ঢেউ। পূর্ণিমার আকাশ ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। সেই ক্ষণে জন্ম বলে বাবা নাম রেখেছিলেন ‘নির্মলচন্দ্র’। পরে বদলে ‘সুনির্মল’।    

প্রদীপ জ্বলার আগে থাকে সলতে পাকানোর পর্ব। কবি জীবনের সেই পর্বটি গিরিডির জলহাওয়ার মতোই মনোরম।

পিতৃকুল-মাতৃকুল দু-দিক থেকেই এব্যাপারে তিনি সমৃদ্ধ।

 পৈতৃক বাড়ি ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মালখানগরে। পিতামহ গিরিশচন্দ্র বসু ছিলেন সেখানকার নামকরা দারোগা। বহু কুখ্যাত অপরাধীকে তিনি কীভাবে নাস্তানাবুদ করেছিলেন তার গল্প লোকের মুখে মুখে ফিরত।

ডাকাত ধরে সরকারী পুরস্কারও পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ডাকাত ধরার সেসব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলেন ‘সেকালের দারোগা কাহিনী’।

লেখালেখি-কবিতা-গল্প দুধ-জলের মতোই মিশে গিয়েছিল চিরকেলে-অভ্যাসে।

মামাবাড়ি গিরিডিতে। সেখানেই তাঁর জন্ম। ১৯০২ সাল। জুলাইয়ের ২০।

 সে বাড়িতে বই আর বই। রবিঠাকুর, শেক্সপিয়র, শেলী, কিটস, বায়রন,ওয়ার্ডসওয়ার্থ কে নেই কাঠের আলমারীতে। সাহিত্য-পত্রিকার সঙ্গে চেনা-শোনার অঢেল সুযোগ। কাঁচা-মনে তার প্রভাব ছিল খুব স্পষ্ট।

দাদামশাই মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা তেজি মানুষ। অভ্রের ব্যবসা ছিল তাঁর। লোকে তাঁকে বলত ‘ Prince of mica mines’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিছুদিনের জন্য তাঁর ব্যবসাসঙ্গী হয়েছিলেন।         

রাজনীতি, দেশপ্রেম আর বিপ্লব, সাহিত্য এই চতুষ্কোণে তিনি আবব্ধ। বিপ্লবী বন্ধুদের নিয়ে সম্পাদনা করতেন ‘নবশক্তি’ পত্রিকা। শ্রী অরবিন্দ, বিপিন পাল ঘনিষ্ঠ বন্ধু।   

বাগ্মী মানুষটি বিপদজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশদের জন্য। তাই ব্রহ্মদেশে নির্বাসিত হলেন একদিন। ইমসিন কারাগারে চোদ্দমাস বন্দী। নিজের জেলবন্দী জীবনের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন। বই আকারে বেরিয়েছিল ‘নির্বাসনের কাহিনী’।

স্বদেশী আন্দোলন, দেশের উত্তাল অবস্থা, ব্রিটিশ বিরোধী ঢেউ গিরিডিতে প্রতিদিনই ছোট-বড় ঢেউ তুলত।

এমন পারিবারিক প্রবাহে বড় হচ্ছিলেন সুনির্মল। বাবা পশুপতি বসুঠাকুর প্রথম জীবনে স্কুলে পড়াতেন। পরে অভ্র ব্যবসায় যোগ দেন। নিজের সাধনায় বিত্ত আর দুই প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন। সঙ্গে সাহিত্য আর বৌদ্ধিক চর্চার আভিজাত্য।

এহেন পরিবেশ এবং পরিচর্যায় তাঁর কবিতার গাছে মুকুল আসতে সময় নেয়নি।

ছোটবেলা থেকেই কাগজ কলম তাঁর জগৎ। কবিতায় অবাধ চলন। প্রথম প্রথম ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। ‘সুনির্মল শর্মা’। একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হত কবিতা। প্রথম কবিতাই প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়।  

গিরিডি থেকে ১৯২০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হলেন কলকাতার সেন্ট পলস কলেজে। পরে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কলেজ ছেড়ে দেন ।

তাঁর দ্বিতীয় টান ছিল ছবি আঁকা। আঁকা-শেখার ‘সিরিয়াস’ ছাত্র ছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন অবন ঠাকুরের ইস্কুলে। ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’-এ।     

 

নিজের প্রথমদিককার কাব্যগ্রন্থের ছবি তিনি নিজেই আঁকতেন।

জীবনে লেখা ছাড়া আর কখনও কিচ্ছু ভাবেননি। লেখাই নেশা। লেখাই পেশা। লেখাই ঈশ্বর।

বাণীর ঈশ্বরী তাঁর প্রতি সহস্র পদ্মে সদয়া। কবির লেখনীও তাই দরাজ হয়েছে মুক্ত গতিতে।

শিশু সাহিত্য পেয়েছিল অন্য মাত্রা। নির্মল, স্বচ্ছ তার চলন।

ছড়া, কবিতা, ছোটোগল্প, উপন্যাস, রূপকথা, ভ্রমণকাহিনী, কৌতুক নাটক সব কিছুই লিখেছেন।

তবে ছড়ার ছন্দে তিনি মহারাজা। লেখনীর জাদু এমনই যে একবার শুনলেই কানে বসে যায় ছেলে বুড়োর।

লাইনে লাইনে হইচই,হুল্লোড় আর বেজায় মজা। ছড়ার মধ্যেই আবার জীবনের গল্প। ছেলেমানুষি হাসির ছলে দর্শনের পাঠ।

‘ছড়ার ছবি’, ‘ছবির ছড়া’, ‘ছড়ার ছবিতে অ-আ-ক-খ’, ‘ছড়ার ছবিতে জানোয়ার’, ‘ছড়ার ছবিতে পাখি’। এই বইগুলো এক সময় বাঙালি শিশুদের ছিল বড় হওয়ার সঙ্গী।

sunirmal-3

কী ঘরে, কী বাইরে সবখানেই। শৈশবের পাঠ ছন্দময় করেছিলেন।

শিশুদের জন্য লিখতে গেলে শিশু ভাবনার পরিসরটিকে ছুঁতে হয়। সহজ সরল জটিলতাহীন তাদের জগৎ। সে জগতের রং-রূপ স্পর্শ করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু কচিকাঁচাদের জগতে তাঁর ছিল অবাধ প্রবেশ।

মানুষটি নিজেও ছিলেন সেরকমই। অপার মুগ্ধতা নিয়ে জগৎ দেখতেন। যেখানেই দৃষ্টি যায় কেবলই মুগ্ধতা!

 ছোটবেলায় পড়তেন হাসিখুশি, মোহনভোগ, কথামালা, হিতোপদেশ। খুব ভাল লাগত। মাঝে মাঝে মাঝরাত্তিরে উঠে মোমবাতির আলোয় ওইরকমভাবে লেখার চেষ্টা করতেন। মনে মনে ভাবতেন ‘বই’ লিখছেন।

নিজে নিজে একটা ছদ্মনামও নিয়েছিলেন। ‘সুনির্মল শর্মা’। বিদ্যাসাগরের বইতে দেখতেন নাম লেখা ‘ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা’। সেই দেখি শিশু সুনির্মিল তাঁর নিজের নামটিও লিখতেন ‘সুনির্মল শর্মা’।  

sunirmal-1

হাওয়ার দোলা (১৯২৭), ছানাবড়া, বেড়েমজা, হৈ চৈ, হুলুস্থূল, কথাশেখা, পাততাড়ি, ছন্দের টুংটাং (১৯৩০), আনন্দ নাড়ু, শহুরে মামা, কিপটে ঠাকুরদা (১৯৩৩), টুনটুনির গান, গুজবের জন্ম, বীর শিকারী, লালন ফকিরের ভিটে, পাতাবাহার, ইন্তিবিন্তির আসর (১৯৫০) ও পাহাড়ে জঙ্গলে আরও অনেক। একশোর বেশি বই লিখেছিলেন।

শিশু সাহিত্যের ধারায় তিনি এক আশ্চর্য তারকা।  

ছোটোদের চয়নিকা ও ছোটোদের গল্পসঞ্চয়ন তাঁর সম্পাদিত দুটো উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ-গ্রন্থ । বহু ধারায় বিভক্ত ছিল জীবন।

 কবি সুনির্মল বসু সমকালের একমাত্র শিশুতোষ পাক্ষিক পত্রিকা 'কিশোর এশিয়া'র পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন ।

দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের শিশু-সাহিত্য শাখার সভাপতির দায়িত্বও তিনি সামলেছেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘ভুবনেশ্বরী’ পদকে সম্মানিত হন ১৯৫৬-এ।

sunirmal-2

শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রথম বিদ্যাসাগর পুরস্কার (মরণোত্তর) তাঁকে প্রদান করা হয়।

শুধু লেখার কবি তিনি নন, তিনি লেখা শেখানোর কবিও।

যেসব ছোটরা লিখতে চায়, কিন্তু লেখার পথ পায় না তাদের জন্য লিখেছিলেন ‘ ছোটদের কবিতা শেখা’।

কবিতা আর ছন্দের বীজ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন শিশুদের মনের কাঁচা মাটিতে। সফল হয়েছিলেন। তাঁর ক্লাসের ছোটরা কেউ কেউ কবি হতে পেরেছিল। অনেকেই পারেনি, কিন্তু আজীবনের জন্য মনে মিশে গিয়েছিল ছন্দের ধারাটি। সেখানেই তাঁর জিত।  

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...