"পুছতে হ্যাঁয় উয়ো, কে গালিব কৌন হ্যায়
কোই বাৎলাও কে হম বাৎলায়ে ক্যা?"
"শুধোন উনি, বলতে পারো গালিব নামক বস্তুটা কে
আমি তখন কী বলব আর? দেখায় যদি দেখাক লোকে।"
এ যেন এক দরবেশী কথোপকথন। এক দরবেশ পরিচয় করাচ্ছেন অন্যজনকে। তবে এ পরিচয় সামনাসামনি নয়, শব্দে আর অক্ষরে। এক জনের অনুভব ধরা দিচ্ছে অন্যের ভালোবাসায়।
তার কাছে গালিব অতি ধুরুন্ধর। তাকে ধরি ধরি মনে করি, কিন্তু নিজে না চাইলে সে ধরা দেয় না। গালিবকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলেন "আনন্দ ভৈরবী"র কবি।
১৩৮১ বঙ্গাব্দের পৌষে প্রকাশিত হয় "গালিবের কবিতা"। অনুবাদে শক্তি চট্টোপাধ্যায়। গালিব সফরে তার সঙ্গী ছিলেন তাঁর পুলিশ বন্ধু আয়ান রশীদ। বীরভূম সিউড়ি অঞ্চলের ডাকসাইটে পুলিশ কর্তা। ইংরেজি-উর্দু-ফারসি-বাংলা চার ভাষাতেই জবরদস্ত।
গালিবকে নিয়ে জমে উঠত তাদের আসর। ঘোর নামত কবি সঙ্গের আসরে। কিন্তু ও কবির নামটি যতই 'শক্তি চাটুজ্জে' হোক, সহজে ধরা দিতে চায়নি গালিব।
শেষ পর্যন্ত বছর দেড়েক কাটিকে অবশেষে দেখা হয়েছিল দুজনার। এক বাউন্ডুলের সঙ্গে আর এক বাউন্ডুলের। শক্তি পেয়েছিলেন একলা বাতির মতো গালিবকে।
গালিব প্রেমে পড়েছিলেন কলকাতার। সে গল্প বলেছিলেন শক্তি। কিন্তু কলকাতা হৃদয় ভেঙেছিল দিল্লির মুসাফিরের। তাঁকে ফিরতে হয়েছিল খালি হাতে।
গালিবের সঙ্গে কলকাতার নতুন করে পরিচয় করিয়েছিলেন কলকাতার কবি। গঙ্গা-যমুনার স্রোত হয়েছিল এক।
"কোই বিরানী সি বিরানী হ্যায়
দশতকো দেখকে ঘর ইয়াদ আয়া"
শক্তি লিখলেন, "নির্জনতা ভীষণ এবং নির্জনতা প্রচন্ড তা
বাড়ি দেখলে মনে পড়ছে পোড়ামাটির খোয়াই কথা"
গালিবের লাইন অজান্তেই হয়ে উঠেছে শক্তির। অক্ষরে অক্ষরে রোদ ফেলছে তার নিজের কথা। খোয়াই দেশের রঙ মিলেছে সেখানে।
বারবার শান্তিনিকেতন ছুঁটে যেতেন শক্তি। ভুবনডাঙা, জ্যোৎস্না রাত, মহুয়া টান। রাঙা মাটির পথ ডাকত...
শক্তির গালিব একা। দুঃখী। অভিমানী। অপমান সয়ে সয়ে বেঁচে থাকা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে তার। অভিধানে নেই সংযম।
"লাজিম থা দেখ মেরে রাস্তা কোই দিন অওর
তনহা গ্যয়ে হো অব রহো তনহা কোই দিন অওর"
অনুবাদে সে পংক্তি হয়েছিল -
"তোমার উচিত ছিল আরো কিছুদিন আমার অপেক্ষা করাই
এখন যখন একা আছো কিছুদিন একাই থাকো।"
একাকিত্বের ধারে বারবার এক হয়ে যান শক্তি-গালিব। এক হয়ে যায় দুটি ভিন্ন অস্তিত্ব। দেওয়াল থাকে না কোনও।
"বেদরও দিওয়ারকে এক ঘর বনানী চাহিয়ে
কোই হমসায়াহ নহ হো অওর পাসবাঁ কোই নহ হো"
গালিবের কবিতায় বাংলা ভাবের অবকাশ নেই। উর্দুর মেহেকে বাংলার সুবাস আনা কঠিন। তবু শক্তি করলেন। তাঁর লালন সাঁই, বাউলের আখড়া, কেঁদুলির মোহ মিশে গেল উর্দু নাজমের শরীরে। এ যেন নব অঙ্গরাগ।
"দরজা এবং দেয়াল ছাড়াই বানিয়ে যাবো এমন বাড়ি
পড়শি বলতে থাকবে না কেউ, থাকবে না দুয়ারে দ্বারী।"
উর্দুর বুকে পদ্যের মন্তাজ। চাঁদের সুরে ভুবন ডাঙায় ডানা মিলল ঝরোখা-হাভেলির কবিতা।
গালিব বলেছিলেন,
"রহিয়ে অব এয়সি জাগহা চল করে যাঁহা কোই নহ হো
হমসুখনা কোই নহ হো অওর হমজবা কোই নহ হো"
এমন শের-এর তর্জমা শক্তির খাতায় হয়ে উঠেছিল
"এবার চলো বেরিয়ে পড়ি, থাকি এমনভাবে
আমার বুঝবে না কেউ, না কেউ সুরে সুর মেশাবে"
গালিবের সঙ্গে এভাবেই কথা বলতেন তিনি। বীরভূম-সিউড়ি-কলকাতা পেরিয়ে দেখা হত দুজনের। তার সঙ্গে দেখা না করে কোন কিছুতেই মন বসত না তাঁর।
ভুবন ডাঙার বাউন্ডুলে তাই লেখেন, "অনেক দিন গালিব না করে মাছ ধরতে বসে মাছ মেলেনি। তখন ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আজ তোমার ওপর অনেক কাজ করেছি। মাছ দাও গালিব। মাছ দেয়নি। আমাদের থেকে অনেক ধুরন্ধর সে..."
তথ্য ঋণ: ( গালিবের কবিতা: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)