সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যকথার গল্পগাথা

ছেলেটির নাম রাখা হল, 'ঝড়ি'। ডাকনাম। কেন? ওমা, একে ফেব্রুয়ারি মাস, তায় আবার নাগাড়ে ঝড়; তার মধ্যেই রাতদুপুরে ছেলেটির জন্ম। সে এক ছিষ্টিছাড়া কাণ্ড! সকলেই ভাবলেন যে, এ-ছেলে ঝড়ের মতো মহাদুরন্ত না-হয়ে যায় না! তাই 'ঝড়ি' নামে হাঁকডাক শুরু হল।

ভাগ্যিস, অবিলম্বে ছেলেটির একটি ভালো নামও রাখা হল, 'সত্যেন্দ্রনাথ'। আরও ভাগ্যিস, তাতে ঝড়ের নামগন্ধও রাখা হল না। নইলে মুরুব্বিদের মান নিয়ে টানাটানি হয়েছিল আর কী! কেননা, সত্যেন্দ্রনাথ তাঁদের ভাবনার সত্যতা রক্ষায় কসুর করে হয়ে উঠেছিলেন একেবারেই শান্তশিষ্ট নির্বিবাদী মানুষ।


মনীষীর বংশে জন্ম। পিতামহ অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন উনিশ শতকের সাহিত্য-সংস্কৃতির চাঁই। দুর্দান্ত পণ্ডিত। অত্যন্ত সুলেখক।


সত্যেন্দ্রনাথের চার বছর যখন বয়স, তখন পিতামহ মারা গেলেন। কাজেই তাঁর সান্নিধ্যে বাড়তে বাড়তে সত্যেন্দ্রের বড় হয়ে ওঠা হল না। তবে এই পর্বে পিতামহের বিশাল লাইব্রেরির সান্নিধ্য তিনি যেমন পেলেন, তেমনি পেয়েছিলেন রক্তসূত্রে জ্ঞানস্পৃহা।

আর এই সূত্রেই সাহিত্যক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশস্পৃহাও জেগেছিল বুঝি মনে। আপন মামা কালীচরণ মিত্র 'হিতৈষী' নামে একখানা সাপ্তাহিক পত্রিকা এই সময় প্রকাশ করছিলেন, সেটি এই দ্বিতীয় স্পৃহায় ক্রমাগত ইন্ধন জোগাতে লাগল। 


তখন সত্যেন্দ্রের বছর চোদ্দ বয়স। বাবার সঙ্গে মধুপুর-দেওঘর বেড়াতে যাবেন। যাবার আগেরই একটি ঘটনা বলি:


এই সময়টায় নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখার সাধটি একেবারে মাথায় চড়ে বসল সত্যেন্দ্রের। ব্যস, ছাপাখানা থেকে নিজের নামের ক'খানা অক্ষর তুলে এনে কালি লেপে বসে গেলেন সাদা খাতায় নাম ছাপতে। ছেপে ছেপে খাতাখানা একেবারে ভরিয়ে ফেললেন। তাতেও সাধ মিটল না। নামে নামে পাঠ্যপুস্তক ছয়লাপ হল, মায় দেওয়াল অব্দি। নাহ্, তাতেও হল না; পরদিন সক্কাল সক্কাল সটান মামাকে গিয়ে ধরলেন নামখানা তাঁর পত্রিকায় ছাপিয়ে দিতেই হবে!

SatyendraNathDutta1

ভাগ্নের সাধটিকে মামা কিন্তু চূড়ান্ত গুরুত্ব দিলেন। প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বললেন, মধুপুর তো যাচ্ছ, ওখানে গিয়ে একখানা সংবাদ লিখে পাঠিও। লেখার সঙ্গে নামও ছাপব, কেমন! 

ব্যস, ভাগ্নেকে আর পায় কে! 'মধুপুর হইতে দিন কয়েক পরেই বালক সত্যেন্দ্র একটি সংবাদ লিখিয়া পাঠায়। লিখন-ভঙ্গী অতি সুন্দর হইয়াছিল। সেই প্রথম রচনা প্রেরকের নাম সহ যথারীতি সাপ্তাহিক "হিতৈষী" পত্রে প্রকাশিত হয়।" [কালীচরণ মিত্র, 'সত্যেন্দ্রনাথের কথা' "প্রবাসী", শ্রাবণ, ১৩২৯ বঙ্গাব্দ।]


ওই 'সংবাদ'টি নিশ্চয় কোন কবিতা ছিল, কিংবা ছড়া। মধুপুর সম্পর্কে। এ-বিষয়ে মামা তাঁর স্মৃতিতে স্পষ্ট করে কিছু লেখেননি। 


তবে ততদিনে যে সত্যেন্দ্র ছন্দের প্যাঁচ সম্পূর্ণ বুঝে ফেলেছেন এবং তার ছাঁদে কথা বসাতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন--এমন সাক্ষ্য সত্যেন্দ্র নিজেই দিয়েছেন। 'ছন্দসরস্বতী' গ্রন্থে তিনি লিখছেন, "বারো উৎরে তেরোয় পা দেওয়ার মাসখানেকের মধ্যেই ছন্দসরস্বতী স্কন্ধে এসে ভর করলেন।" "বেণু ও বীণা" কাব্যের 'স্বর্গাদপি গরীয়সী' এই বারো বছর বয়সে লেখা কবিতা।

সাহিত্যরচনার প্রথম সোপান বেশিরভাগক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, অক্ষম হোক বা সক্ষম, কবিতা দিয়েই শুরু হয়। সত্যেন্দ্রের জীবনে সেই শুরুর শুরুটা কীভাবে হল, তার একটি আভাস মামার স্মৃতি থেকেই পাচ্ছি:

"আত্মীয় শ্রীপূর্ণচন্দ্র ঘোষ ও প্রকাশচন্দ্র ঘোষ মসজীদবাড়ী স্ট্রীটের বাড়িতে থাকিয়া তখন পড়াশুনার সঙ্গে-সঙ্গে সাহিত্যচর্চ্চাও করিতেন। বালকের অনুরোধে প্রকাশচন্দ্রকে নিত্যই হয় একটা নূতন ক্ষুদ্র কবিতা লিখিয়া, নয় একখানা ছবি আঁকিয়া দিতে হইত। নিজস্ব সম্পত্তি ভাবিয়া বালক তাহা লইয়া গৃহপ্রাঙ্গণ আনন্দ-মুখরিত করিয়া তুলিত।" 

পরের সৃষ্টিকে নিজের ভেবে আনন্দ করতে করতে একদিন বালক নিজেই সৃষ্টি করতে শুরু করলেন। মত্ত হলেন আপন সৃষ্টির আনন্দে। 

কবিতার মধ্য দিয়ে বাড়তে বাড়তে সত্যেন্দ্র যখন স্কটিশচার্চ কলেজে পড়ছেন, তখন মামার প্রথম গল্পের বই 'যুথিকা' প্রকাশ পেল।

এবং, ঘটনাটি ভাগ্নেকে যথেষ্ট আলোড়িত করল। যথারীতি অঙ্কের খাতায় ভাগ্নে গল্প ফাঁদতে শুরু করলেন। অবিলম্বে পড়াশুনোর তদারক করতে গিয়ে মামা গল্পটি আবিষ্কার করলেন। পড়ে মনে মনে বেশ খুশিই হলেন। কিন্তু, সেই খুশির প্রকাশ ঘটালে ভাগ্নে উৎসাহের চোটে পাছে গণিত ছেড়ে গোল্লায় যাবার রাস্তা ধরে, তাই উল্টে মন্দ মন্দ ধমক দিলেন। তাতে ভাগ্নে সত্যিই মৃদু দমে গেলেন।

SatyendraNathDutta2

এতে দুটি ব্যাপার ঘটল। এক, সত্যেন্দ্র মৌলিক গল্প লেখায় প্রাথমিকভাবে ক্ষান্তি দিলেন। দুই, মামার দেখাদেখি নিজের প্রথম কাব্য 'সবিতা' স্বনামে প্রকাশ করলেও ক্যাটালগে নিজের নামের জায়গায় লেখালেন বন্ধু সৌরীন্দ্রমোহন মজুমদারের নাম। কারণ, ক্যাটালগটি মামা ও বাবার হাতে পড়ার প্রভূত সম্ভাবনা, তাই।

'সবিতা' স্বনামে ছাপানো হলেও। প্রকাশিত হল অত্যন্ত গোপনে। বন্ধু সৌরীন্দ্রমোহন মজুমদারের জমানো টাকায়। অনেক ধরে-টরে প্রকাশক হিসেবে 'গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স'-এর নাম ব্যবহার করার অনুমতি আদায় করা গেল। কারণ, 'গুরুদাস' বাংলা সাহিত্যের অভিজাত প্রকাশক। এতে বইটির প্রকাশনাগত আভিজাত্য যেমন বাড়ল, তেমনি তা 'গুরুদাস'-এর ক্যাটালগেও স্থান পেল।

ক্যাটালগে স্থান পেলেও সাহিত্যরসিকদের মনে 'সবিতা' স্থান পেল না। তেরো টাকায় 'সবিতা' ছাপা হয়েছিল তিনশো কপি। এক বড়লোক বন্ধু শুধু চার আনা দিয়ে কয়েক কপি কিনল। ব্যবসায়িক খাতে বাকি বারো টাকা বারো আনা টোটাল লস। বাদবাকি আর এক কপিও বিক্রি হল না। অখ্যাত কবির অখ্যাত লেখা কে-ই বা কিনবে! কে-ই বা বেচবে! যে-কটি সাময়িকপত্রে সমালোচনার জন্য বইটি দেওয়া হল, তাঁরা কেউই বইটি সম্পর্কে এক অক্ষরও খরচ করলেন না।

তা না-ই করুন গে, সত্যেন্দ্রদের উৎসাহ তাতে মোটেই ভাঁটা পড়ল না। অবশিষ্ট বই বিলোতে শুরু করলেন সহপাঠীদের মধ্যে। তারই মাঝে একদিন অধ্যাপক-সাহিত্যিক ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ-মশাইকে দুরু দুরু বুকে লাজুক সত্যেন্দ্র একখানা বই দিয়ে এলেন। 

ক্ষীরোদপ্রসাদ আনাড়ি সত্যেন্দ্রের সৃষ্টিকে আর-পাঁচজন প্রতিষ্ঠিতের মতো অবজ্ঞা করলেন না। মন দিয়ে পড়লেন। তারপর একদিন ডেকে বললেন, "তোমার কবিতা বেশ লেখা হয়েছে, অভ্যাস কর, ভবিষ্যতে সুকবি হবে।" 

ক্ষীরোদপ্রাসাদের ভবিষ্যৎবাণী যে কতদূর সফল হয়েছিল, তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি 'ছন্দের যাদুকর'; আমাদের কাছে সৃষ্টির...'পালকির গান', 'ঝর্ণা', 'দোরখা একাদশী', 'জাতির পাঁতি' যার সার্থক সোপান...


তথ্যঋণ:

১. 'ছাত্রজীবনে কবি সত্যেন্দ্রনাথ'-সৌরীন্দ্রমোহন মজুমদারের, শারদীয় দেশ, ১৩৮৯ বঙ্গাব্দ।

২. 'সত্যেন্দ্রনাথের কথা'-কালীচরণ মিত্র, "প্রবাসী", শ্রাবণ, ১৩২৯ বঙ্গাব্দ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...