কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর 'কবিতার বোঝাপড়া' বইটির একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ হলেন দেওয়ালের মতো, কবিতার রাস্তায় সেই দেওয়াল ধরেই তাঁর হাঁটতে শেখা। ক্রমে অবশ্য সেই দেওয়াল ছেড়ে নিজস্ব পথ তিনি খুঁজে নিয়েছিলেন। এই আত্মবীক্ষার সঙ্গে অনেক আধুনিক কবির আত্মবীক্ষাই হয়তো মিলে যাবে। যেমন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কথাই ধরুন, তিনি সেই আত্মবীক্ষাই প্রশ্নের আকারে উপস্থাপিত করেছিলেন 'পূর্বাচল' পত্রিকার পাতায় গত শতকের চারের দশকে: 'রবীন্দ্র-প্রভাব অতিক্রম করে সত্যিকারের ভালো কবিতা লেখা এ যুগে কার পক্ষেই বা সম্ভব হয়েছে?' যাঁর পক্ষেই সম্ভব হোক না কেন, কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী সেই সম্ভাবনার পথে হাঁটতেই চাননি। তাঁর রবীন্দ্রমুগ্ধতা ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। তাই রবীন্দ্রনাথকে গুরুর আসনে বসিয়ে আত্মঘাতী হতে তাঁর দ্বিধা হয়নি। রবীন্দ্রনাথের ভাব-ভাষা-আঙ্গিক-চিত্রকল্প-দৃষ্টিকোণ সচেতনভাবে অনুসরণ করেছেন। তাই সমালোচকবর্গের কাছে 'রবীন্দ্রানুসারী কবিসমাজ'-এর একজন হয়েই থেকে গেলেন আজীবন, কবিকুলে কুলীন হওয়া তাঁর জীবনে আর ঘটল না। মরণোত্তরেও না। অথচ তাঁর কবিতার স্বভাবে শব্দ দিয়ে ছবি আঁকবার, সহজ কথাকে সহজভাবে বলার আশ্চর্য গুণ ছিল, অনায়াস নাটকীয়তা ছিল, মন কেমনের দেশ ছিল, আবার অহেতুক ভালো লাগার উপবনও ছিল। ছিল কেন, এখনও আছে।
সেই যে 'বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই--/ মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?' ('দিদি-হারা') কবিতার কথা আপামর আমরা সবাই জানি। জানি কেন? কবিতাটি গান হয়েছে বলে? রেকর্ড হয়ে ঘরে ঘরে একদা পৌঁছে গিয়েছিল বলে? তা বোধহয় না। কত কবিতাই তো গান হয়েছে, বিখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠে রেকর্ড হয়েছে; সেগুলি সবই কি আমাদের এমন আপন হয়ে উঠতে পেরেছে? পারেনি। 'দিদি-হারা' পেরেছে। কারণ, কবিতাটির মধ্যে যে শিশুসুলভ সহজ আবেদন আছে, সেই আবেদনে বুকের শিশুটা জেগে ওঠে, অনেক না-পাওয়া বেদনা নিয়ে সে হাহাকার করে ওঠে। এই যে শব্দ দিয়ে কবিতার হাহাকারকে সবার মধ্যে চারিয়ে দেওয়া, সার্থক শব্দশিল্পী না হলে সেটা সম্ভব হয় না।
জীবনের প্রথম কবিতাটিও যতীন্দ্রমোহনের অন্তরলোকে আদিকবির মতোই হাহাকার থেকে উৎসারিত হয়েছিল। কবি তখন হেয়ার স্কুলের ছাত্র। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন। তারিখ, ২৯ জুলাই ১৮৯১। ক্লাসে শুনলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যু সংবাদ। শুনে মনের ভেতর দারুণ কষ্ট হল। কাঁদতে ইচ্ছে হল। আর সেই চেপে রাখা কষ্ট কষ্ট কান্না থেকে জন্ম নিল কবিতা। লিখে ফেললেন খাতায়। পড়ে শোনালেন বন্ধুদের। বন্ধুরা সবাই শোকসন্তপ্ত মনে শুনলেন সেই শোক-কবিতা। তাঁদের কবিতাটি এত ভালো লাগল যে, চাঁদা তুলে কবিতাটি তাঁরা হ্যান্ডবিলে ছাপিয়ে ফেললেন। প্রথম কবিতার এত দ্রুত ছাপার অক্ষরে মুক্তিলাভ, গত শতক অব্দি পৃথিবীর কাব্য-কবিতার ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।
চকিত আবেগে প্রথম কবিতা তো হল। কিন্তু, সচেতনভাবে যতীন্দ্রমোহন কবিতার রাজ্যে যখন প্রবেশ করলেন, তার আগেই রবীন্দ্রকাব্যে দিকবদলের বিজয়নিশান উড়তে শুরু করেছে। সেই নিশানে আকৃষ্ট হলেন যতীন্দ্রমোহন। অন্তরজুড়ে বরণ করলেন রবীন্দ্রনাথকে। অর্জন করলেন রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'লেখা' প্রকাশিত হল ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। তবে, যতীন্দ্রমোহনের অনুরোধে প্রকাশের আগে সস্নেহে রবীন্দ্রনাথ কাব্যটি আগাগোড়া সংশোধন করে দিয়েছিলেন। এই প্রথম কাব্যটি কবি গুরুর নামে উৎসর্গ করেছিলেন।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যজীবনে এবং রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় কবির মোট ন'টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। তার প্রতিটির জন্যই কবি রবীন্দ্রস্পর্শ প্রার্থনা করেছিলেন, তাঁর আশীর্বাদে ধন্য হতে চেয়েছিলেন। যেভাবে প্রথাগত গুরুশিষ্য-সম্পর্কের ক্ষেত্রে, শিষ্য তাঁর প্রিয় জিনিসটিতে 'গুরুস্পর্শ' ঘটিয়ে ধন্য হতেন, সেভাবেই যতীন্দ্রমোহন হয়তো তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিতে গুরুস্পর্শ পেতে চেয়েছিলেন। এই পুনরাবৃত্তিতে কবিগুরু অনেকসময়ই যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু যতীন্দ্রমোহন তাতে কখনোই দূরে সরে যাননি। বরং, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কাব্যে দুর্নীতি আমদানির অভিযোগ তুললে, দ্বিজেন্দ্রলালের বন্ধু হয়েও যতীন্দ্রমোহন চাঁছাছোলা ভাষায় তার প্রতিবাদ করেছেন। গুরুর অপমানে বন্ধুকে রেয়াত করেননি। রবীন্দ্র-অনুসরণের জন্য জীবদ্দশাতেই যতীন্দ্রমোহন দেখেছেন তাঁর কাব্যকৃতি থেকে পাঠককে মুখ ফিরিয়ে নিতে, ব্যথিত হয়েছেন তাতে, কিন্তু পথ-বদল করেননি। সর্বস্ব পণে ও গুরুপদ বন্দনায় তিনি ছিলেন একলব্যের মতোই একনিষ্ঠ। সেখানে তিনি একা না হলেও, অনন্য।
তথ্যঋণ : যতীন্দ্রমোহন বাগচীর শ্রেষ্ঠ কবিতা- গোরা সিংহরায় সম্পাদিত।