বিরলধারার কবি জসীমউদ্দিন

এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,

কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল !

কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া,

তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।

 

একদিন এই কবিতার শব্দে শব্দে কেঁদেছিল গোটা বাংলাদেশ। রূপাই আর সাজুর জীবনলতায় বাঁধা পড়েছিল পাঠক। ছন্দবন্ধের মায়া বুননে সহজ প্রেমের কাব্যকথা। নাম তার ‘নকশি কাঁথার মাঠ’।

প্রেম থেকে প্রতিবাদ-এই ছিল কাব্যের গতিপথ । ফসলের ওপর ন্যায্য হকের দাবিতে লাঠি ধরেছিল গাঁয়ের চাষি রূপাই মিয়াঁ। ঘর ছাড়া হতে হয়েছিল তাকে। শূন্য ঘর আগলে পলকা লতার মতো কেঁপে উঠেছিল প্রেয়সি সাজু।

বিপ্লবের আগুন শান্ত হলে ঘরে ফিরে এসেছিল কৃষক বিপ্লবের নেতা রূপাই। তার প্রেমের কাছে। প্রেয়সি তখন গোরে।

সুখদিনের কথাদের হারিয়ে যেতে দেয়নি সাজু।  আঙ্গুলের আদর ছুঁইয়ে-ছুঁইয়ে তাদের ধরে রেখেছিল নকশি কাঁথার ডোরে।

প্রেমিকের জন্য অনন্ত অপেক্ষায় ফুরিয়ে নকশিকাঁথা ঠাঁই নিয়েছিল সাজুর কাফনে।

মাটি-ঘুমে ঘুমিয়ে থাকা প্রেমিকার মুখ আর ফিরে এসে দেখতে পাইনি রূপাই মিয়াঁ। শুধু চিনেছিল গোরের মাটির ওপর বিছিয়ে রাখা কাঁথাখানাকে। তাদের প্রেমের নকশিকাঁথা।   

বারবার পাঠককে এভাবেই কাঁদিয়েছেন তিনি। কলমে প্রেমের স্রোতে বোধহয় রক্ত আর চোখের জল দুই মিশে যেত তাঁর। নাহলে মেঠো গাঁয়ের খোলামকুচি-জীবনের গল্পে এমনভাবে মায়া মেশাতেন কীভাবে!

পাঠক তাঁর নাম দিয়েছিল ‘পল্লীকবি’। কবি জসীমউদ্দিন। জন্ম ১৯০৩ সন। ফরিদপুর জেলার় তাম্বুলখানা গ্রামে। বাবার নাম আনসারউদ্দিন মোল্লা। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট।

কবি জসীমউদ্দিন ছাত্রবেলা থেকেই অন্যরকম। বিরলধারার।

১৯২৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা 'কল্লোল' এ প্রকাশিত হয় কবিতা 'কবর'।

তার ঠিক তিনবছর পর ১৯২৮ সালে কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকের তালিকাভুক্ত করার জন্য নির্বাচিত করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

যে কোনও নবীন কবির কাছেই এ অতি দুর্লভ সম্মান। ওই একই বছরে প্রকাশিত হয়  'নকশীকাঁথার মাঠ' ।

তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল লোকজীবনের সঙ্গে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গী ছিলেন গবেষণায়। বাংলা লোকসাহিত্য সংগ্রাহক হিসাবে কাজ করতেন।

 প্রায় দশ হাজারেরও বেশি লোকসংগীত সংগ্রহ করেছিলেন।

একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। ১৯৪৪ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে কাজ শুরু করেন। বাকি কর্মজীবন সেখানেই।

 পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। লোক সঙ্গীত সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে গ্রাম জীবনকে দেখেছিলেন একেবারে সামনে থেকে। সেই মাটির রূপ-রস-গন্ধ হয়ে উঠেছিল তাঁর কলমের স্বর। কবিতার মায়া।

 তাঁর কবিতা আবেগের চকমকি। পংক্তিতে ঘুমিয়ে থাকত আগুন। ছুঁলেই জেগে উঠত প্রেম আর প্রতিবাদ। নিজে ব্যক্তিগত জীবনে সমাজতান্ত্রিক ভাবনার মানুষ ছিলেন।

সেই বোধ প্রভাব ফেলেছিল বাংলাদেশের লোকজ জীবন নিয়ে লেখা সাহিত্যতেও। তাঁর কবিতার দর্শন সেই সুরেই কথা বলত।

কবিতায় এক হয়ে গিয়েছিল দেশ-কাল। তার সীমান্তহীন।

জসীমউদ্দীন বাংলাদেশের ‘প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরমেন্স’ পুরস্কার (১৯৫৮) পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৪-এ তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

জসীমউদ্দীন এক আশ্চর্য কবি। এই ছিল তাঁর আজীবনের পরিচয়। হেলাফেলার ছোটজীবনগুলোকে আদর দিয়েছিলেন কলমের কান্নায়। ঘর পেয়েছিল তারা...

 

ও আমার গহিন গাঙের নায়া,

ও তুমি অফর বেলায় লাও বায়া যাওরে-

কার পানে বা চায়া।

ভাটির দ্যাশের কাজল মায়ায়,

পরাণডা মোর কাইন্দা বেড়ায়রে-

আবছা মেঘে হাতছানি দ্যায়,

কে জানি মোর সয়া।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...