কবিতা, অর্থনীতি এবং সিনেমা, তিনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের হয়ে ওঠা। বাবা ছিলেন রেলের ডাক্তার। বদলির চাকরি। ফলে, শৈশব থেকে বড় হয়ে কলকাতায় আসা অব্দি বাংলা এবং বাকি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক পরিবেশের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে পরিচিত হবার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। মা ভালোবাসতেন গানবাজনা, কবিতা। গাইতেন, পাঠ করতেন, আবৃত্তি করতেন। বাল্যের গ্রহণ করবার দুর্বার ক্ষমতায় সে-সব আত্মায় ধারণ করে নিজেকে ঋদ্ধ করেছিলেন বুদ্ধদেব।
ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ কলকাতায় এসে বাবা থিতু হলেন। তখন মামা কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তের সান্নিধ্য পাবার সুযোগ পেলেন বুদ্ধদেব। এই সন্নিধ্যই কবিতার পথে তাঁকে হাঁটিয়ে ছাড়ল। মাত্র চোদ্দ-পনের বছর বয়সেই নানান পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা স্থান পেতে শুরু করল। মামা 'কৃত্তিবাস' পত্রিকা তথা কৃত্তিবাসগোষ্ঠীর অন্যতম কবি।
তাঁর সূত্রে বুদ্ধদেবও জড়িয়ে পড়লেন এই পত্রিকার সঙ্গে। হয়ে উঠলেন সুনীল-শক্তির পরবর্তী কবিতাধারার অন্যতম পদাতিক। খুঁজতে লাগলেন নিজস্ব কাব্যভাষা। সফল হলেন। একে একে লিখে ফেললেন, 'গভীর আড়ালে', 'ছাতাকাহিনী', 'রোবটের গান', 'কফিন কিংবা স্যুটকেস', 'ভোম্বলের আশ্চর্য কাহিনী ও অন্যান্য কবিতা' নামে ভিন্নরীতির কবিতা-সম্বলিত গ্রন্থ।
সিনেমাও পেয়েছিলেন তিনি মামার সূত্রে। 'ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি' আন্দোলনে সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল, চিদানন্দদের সঙ্গী ছিলেন মামা। সোসাইটির সদস্য ছিলেন। মামার সঙ্গে ছবি দেখতে যেতেন কিশোর বুদ্ধদেবও। এভাবেই অভ্যেস তৈরি হল ছবি দেখার। চর্চা শুরু হল অন্তরলোকে এবং লোকমহলে।
ত্রুফো, গদার, রিভেত, বুনুয়েলের ছবি মনে দাগ ফেলতে ফেলতে একটা সময় ছায়ালোকের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ করে তুলল বুদ্ধদেবকে। ততদিনে তিনি বর্ধমানের একটি কলেজে রীতিমতো অর্থনীতির অধ্যাপক। কলকাতাতেও একটি কলেজে পড়ান। তবু প্রাণের টানে সে-সব ছেড়েছুঁড়ে একদিন ঝাঁপ দিলেন সেলুলয়েডের মায়ালোকে।
আত্মপ্রকাশ করলেন তথ্যচিত্র-পরিচালক হিসেবে। তার মধ্য দিয়েই নেওয়া চলল আলো ও ছায়াকে বাঙময় করে তোলার শিক্ষা। একে একে পরিচালনা করলেন, 'দি কন্টিনেট অব লাভ' (১৯৬৮), 'ঢোলের রাজা ক্ষীরোদ নট্ট' (১৯৭৩), 'ফিসারম্যান অব সুন্দরবন' (১৯৭৪), 'দি কিং অব ড্রামস' (১৯৭৪)। 'দি কিং অব ড্রামস' শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্রের জাতীয় পুরস্কার পেল। বয়ে চলল তথ্যচিত্রের ধারা। ১৯৭৫-এ নির্মাণ করলেন সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ওপর একটি তথ্যচিত্র, 'শরৎচন্দ্র'। তারপরই হাত দিলেন পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছায়াছবি পরিচালনায়।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পে চিত্রনাট্য লিখলেন। অর্থনীতির পাঠ নেওয়া বুদ্ধদেব গভীর চোখে দেখা কলকাতার মধ্যবিত্তের সমসাময়িক সংকটকে তুলে ধরলেন। পরিচালনা করলেন 'দূরত্ব'। ১৯৭৮-এ মুক্তি পেল। 'দূরত্ব' শিক্ষিত বাঙালিকে দোলা দিল। নতুন বাংলা সিনেমার পদধ্বনি শোনাল।
বুদ্ধদেব বিদেশের সিনেমা বোদ্ধাদের কাছেও এই প্রথম ছবিতেই গৃহীত ও নন্দিত হলেন। ইতালির চিত্রসমালোচক গিয়া রোনাদি ছবিটি দেখে লিখলেন, 'It is a memorable film with brilliant patches and reminds us of the work of Rosellini, Goddard and Ray.' ছবিটি লোকার্ন থেকে 'ক্রিটিকস এওয়ার্ড' অর্জন করল। তারপর একে একে বয়ে চলল সৃজনশীলতার ধারা 'নিম অন্নপূর্ণা', 'শীত-গ্রীষ্মের স্মৃতি', 'গৃহযুদ্ধ', 'বাঘ বাহাদুর', 'ফেরা', 'অন্ধিগলি', 'তাহাদের কথা', 'চরাচর', 'উত্তরা', 'লাল দরজা', 'আমি ইয়াসিন ও আমার মধুবালা', 'মন্দমেয়ের উপাখ্যান' পেরিয়ে সাম্প্রতিক 'টোপ' ও 'উড়োজাহাজ' অব্দি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছরের পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র পরিচালনায় বাংলা সিনেমাকে কী দিলেন বুদ্ধদেব? তাঁর ছবির একটা বড় দিক হল, বিষয়-বৈচিত্র্য। সমাজের সঙ্কট থেকে ব্যক্তির সঙ্কট, সম্পর্কের সঙ্কট থেকে সংস্কৃতির সঙ্কট অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে কবির দৃষ্টিকোণে ক্রমাগত বৃত্তাকারে আবর্তিত হয় তাঁর ছবিতে।
ফর্ম বা আঙ্গিকের দিক থেকেও তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। বাংলা সিনেমায় কাব্যিক ইমেজারিকে সিগনেচার করেছেন বুদ্ধদেব, সেটা তাঁর নিজস্বতা। তাঁর আগে সিনেমার ভাষায় ও চিত্রকল্পে কাব্যিকতা কি ছিল না? ছিল। তবে, তাকে নিজের প্রকাশভঙ্গি করে তোলাটা এই প্রথম। বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন লোকফর্মকে বিষয় ও আবশ্যিক মোটিফ করে তুলেছেন সিনেমায়। যেমন : বাঘ নৃত্য, ছৌ নাচ এবং তার মুখোশের ব্যবহার প্রভৃতি।
বাংলা সিনেমায় ম্যাজিক রিয়ালিজম এবং সাররিয়ালিজম বা পরাবাস্তবতার ব্যাপক ব্যবহার তাঁর হাত দিয়েই ঘটেছে। বিদেশের মাটিতে অতীতে তো বটেই, সাম্প্রতিককালেও বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার বিশিষ্ট ও অন্যতম প্রতিনিধি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল।