মহম্মদ আজিজের গায়নকথা

স্কুলে পড়ার সময়, এই ধরুন ক্লাস সেভেন বা এইটের ছাত্র। তখন কতই বা বয়স, তের-চোদ্দ বছর হবে। তো, এ-সময় থেকেই মহম্মদ আজিজ গায়ক মহম্মদ রফির অন্ধ ভক্ত। ভালোবাসেন তাঁর গান গাইতে। 

আর-একটু বড় হতেই আজিজ পাড়ার জলসা, ক্লাবের অনুষ্ঠান প্রভৃতি, যাকে বলে ‘মাচা-প্রোগ্রাম’; তাতে রফির গান গেয়ে আসর একেবারে মাতিয়ে দিতে শুরু করলেন। 'রফিকন্ঠী' হিসেবে অল্পদিনেই শ্রোতাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। বিখ্যাত সব সিনেমা-পত্রিকার পাতায় ততোধিক বিখ্যাত সব গায়ক-গায়িকাদের ছবি দেখতে দেখতে শুরু হল প্লেব্যাক সিঙ্গার হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখা।

সেই স্বপ্ন নিয়ে আরও বছর কয়েক বয়স বাড়ল। অভাবের সংসার এরই মধ্যে তাঁকে রোজগারের প্রয়োজনে মাচা থেকে টেনে নিয়ে এল কলকাতার বার-ক্লাবে। এখানেও তাঁর গানের কদর করবার লোকের অভাব হল না। স্বপ্নের সঙ্গে শ্রোতাদের উৎসাহ তাঁকে বম্বে গিয়ে লড়াই করার আত্মবিশ্বাস এনে দিল। কিন্তু, সংসারের পিছুটান এই মুহূর্তে তাঁকে ঝুঁকি নিতে দিল না।

বাংলার অশোকনগরের ছেলে আজিজ। ডাক নাম, ‘মুন্না’। পাড়ায়-ক্লাবে-বারে তিনি বেশ গাইছিলেন মহম্মদ রফির গান। বেশ চলছিল। এসব অবশ্য সাতের দশকের কথা।

MohdAziz1

মুশকিল হল আটের দশকে পা দিয়ে। রফি হঠাৎ মারা গেলেন। এতে রফিকন্ঠী আজিজ প্রচণ্ড কষ্ট তো পেলেনই, সেই সঙ্গে দারুণ ভাবনাতেও পড়ে গেলেন। 

ভাবনাটা হল, রফি তো চলে গেলেন; আর তো নতুন গান পাবেন না! তাহলে এবার কী গাইবেন! পুরনো গানের সঙ্গে শ্রোতারা নতুন গানও তো শুনতে চায়। কী হবে? 

 

এখান থেকেই আজিজ মরিয়া হয়ে নিজে কিছু একটা করে দেখানোর তাগিদ অনুভব করলেন।  

 

১৯৮২ সাল। বাড়িতে দু’বছর সময় চাইলেন। বম্বে গিয়ে অন্তত দুটো বছর গায়ক হয়ে ওঠার জন্য লড়াই করবেন। মুখে বললেন, কিছু না-হলে তখন না-হয় ফিরে এসে যা করছিলেন তা-ই করবেন! এ তো রইলই হাতের পাঁচ। কিন্তু, জেদ বাঁধলেন মনে মনে-‘হয়ে’ তিনি উঠবেনই, 'হয়ে' তাঁকে উঠতেই হবে! 

বম্বে এসেই যথারীতি ধাক্কা খেলেন। দেখলেন, গান শুনে ‘বাহবা’ দিয়ে পিঠ চাপড়ানোর লোক অনেক আছেন; কিন্তু কাজের কথা বললেই ফিরিস্তি অনেক। তবে হাল ছাড়ার জন্য আজিজ আসেননি। কাজেই শুরু করলেন মিউজিক ডিরেক্টারদের দরজায় দরজায় হত্যে দেওয়া। দিনের পর দিন, হপ্তার পর হপ্তা, মাসের পর মাস। 

শুধুই হত্যে দিয়ে তো আর পেট ভরে না। তাঁরও ভরল না। অভাবী পকেট ইতিমধ্যেই গড়ের মাঠ। ফলে, কলকাতায় যা করছিলেন, অনেক চেষ্টাচরিত্তির করে সেই বারে-ক্লাবে গান গাওয়া শুরু করলেন বম্বেতেও। 

MohdAziz2

পরিস্থিতি যখন এমন, কোথাও কোন দিশা পাচ্ছেন না; ঠিক তখনই হঠাৎ করে আলাপ হয়ে গেল ‘আফতাব পিকচার্স’–এর মালিক সেলিম আফতাবের সঙ্গে। সেলিম সব শুনে মিউজিক ডিরেক্টার অন্নু মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। 

অন্নু সবে বছর দুই হল মিউজিক ডিরেক্টার হিসেবে বলিউডে কাজ শুরু করেছেন। সূত্র পেয়ে আজিজ শুরু করলেন অন্নুর স্টুডিওতে আসা-যাওয়া। অন্নু সুর তৈরি করেন একের পর এক, তিনি বসে বসে শোনেন। এমনি করে দিন কেটে যায়, ছবিতে আর গাওয়ার সুযোগ হয় না।

 

তারপর একদিন সুযোগ এল। টুক করে আস্তানায়। 'হয়ে' ওঠার লড়াই তখন সবে দু'বছর পূর্ণ করে ফেলেছে। 

 

১৯৮৪’র এক সকাল। ফোনের বালাই নেই। তাই অন্নুর পাঠানো একটি লোক এসে তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তারপর সঙ্গে করে নিয়ে গেল স্টুডিওতে। 

 

অন্নু তাঁকে দিয়ে গাওয়ালেন জীবনের প্রথম প্লেব্যাক। মনমোহন দেশাই পরিচালিত ‘মর্দ’ ছবির টাইটল সঙ—‘মর্দ টাঙ্গেওয়ালা’।

 

'কণ্ঠী'শিল্পীর এতদিনে নিজের একখানা গান হল। নিজের কণ্ঠে। নিজস্ব ভঙ্গিতে। যে-গান শুনে লোকে বলবে, 'আরে, এ তো আজিজের কণ্ঠ, এ-হল আজিজের গান!'

MohdAziz3

'মর্দ' থেকেই কিশোর কুমারের পাশাপাশি আজিজও হয়ে উঠলেন অমিতাভের প্লেব্যাক-গায়ক। শুধু তাই নয়, কিশোর কুমারের অকুণ্ঠ প্রশংসাও অর্জন করলেন। তাঁর সঙ্গে ডুয়েট করলেন ক্রমশ এগারোখানা গানে। 

আসলে, মহম্মদ রফির পর আজিজ এমন একজন গায়ক, যিনি অনায়াসেই ছুঁতে পারেন সপ্তম স্বর, নিষাদ। সেই গুণেই তিনি অবিলম্বে অর্জন করলেন সমকালীন বিখ্যাত সব কণ্ঠশিল্পীদের সসম্ভ্রম ভালোবাসা।

১৯৮৫-তে মুক্তি পাওয়া ‘মর্দ’ ছবি দিয়ে শুরু করে ২০০১-এ ‘ঢোল বাজা’ অব্দি অসংখ্য ছবিতে গান গাইলেন আজিজ। ভারতের প্রায় সমস্ত ভাষাতেই। ফিল্মি ও নন-ফিল্মি মিলিয়ে তাঁর গানের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল প্রায় বিশ হাজারে। 

সুফি, কাওয়ালি, মুসলিম ভক্তিগীতি তাঁর কণ্ঠে পেল অনায়াস বিস্তার; তেমনই মর্মস্পর্শী আবেদনে অন্য মাত্রা আনলেন হনুমান চালিশা, তুলসীদাস ও কবীরের দোঁহাতেও। 

 

আজিজের ছায়াছবির তালিকায় চোখ রাখলে দেখা যায় যে: 

তিনি অমিতাভ থেকে শুরু করে দিলীপ কুমার, অনিল কাপুর, জ্যাকি শ্রফ, গোবিন্দা, সানি দেওল, রাজেশ খান্না-সহ তিন প্রজন্মের নায়কের লিপে গান গেয়েছেন। লতা-আশা থেকে শ্রেয়া ঘোষাল-তিন প্রজন্মের গায়িকার সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছেন। শুধু তাই নয়, নৌশাদ-ওপি নায়ার থেকে শুরু করে সঞ্জীব-দর্শন অব্দি তিন প্রজন্মের মিউজিক ডিরেক্টারের সুরেও গান গেয়েছেন। এ বড় কম সৌভাগ্যের কথা নয়!

শুধু হিন্দিতেই নয় মাতৃভাষা বাংলাতেও অসংখ্য গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন আজিজ। তাঁর প্রথম বাংলা ছবি, ‘জ্যোতি’

MohdAziz4

‘পাংচুয়াল’ বলে অভিনেতা অমিতাভের যতটা খ্যাতি, গায়ক মহম্মদ আজিজেরও ঠিক ততটাই। ‘পাঁচটা বলতে’ তিনি ‘পাঁচটাই’ বুঝতেন।

গায়ক হিসেবে তিনি বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন ঠিকই; তবে তিনি বলতেন যে, আশা ও লতার সঙ্গে ডুয়েট গাওয়ার সময় তাঁর স্বর চালনা দেখে তাঁরা যখনই ‘বাহ’ বলে ওঠেন, সেগুলোই হল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারমালা। 

অনেক উপেক্ষা অতৃপ্তির মাঝে অগুন্তি শ্রোতার ভালোবাসা তাঁকে দিয়েছিল অফুরান তৃপ্তি। সেই সব গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের কাছেই তাই তিনি অবিস্মরণীয় সব গান গচ্ছিত রেখে আর্তি জানিয়ে গেছেন-‘মিতওয়া ভুল না জানা...’


তথ্যঋণ: মহম্মদ আজিজের বেশকিছু ভিডিও সাক্ষাৎকার।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...