পিনাকী ঠাকুরের জীবন ও কবিতার ভাষ্য

তখন কতই বা বয়স পিনাকী ঠাকুরের, এগার-বার হবে। ক্লাস সিক্সে পড়েন। সেই সময়ই এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে গেল তাঁর জীবনে। রাতের অন্ধকারে রাজনৈতিক গুণ্ডারা ঘিরে ফেলল বাড়ি। মা, দুই ছোট বোন আর তাঁকে, একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিল। বাবা বামপন্থী শ্রমিক নেতা। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মেটাতেই অসহায় বাবাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল ছাদে, সেখানেই নৃশংসভাবে খুন করল। বন্ধঘরের অসহায় পিনাকী এক অস্পহ্য অবরুদ্ধ যন্ত্রণায় বাবার প্রতি ঘটে চলা প্রতিটি মুহূর্তকে অনুভব করলেন। কিন্তু কিছু করতে পারলেন না। বাবাকে খুন করার পরও ঘাতকের দল তাঁদের নিরুপদ্রবে বাঁচতে দিল না। দুঃস্বপ্নের মতো বোমাবন্দুক নিয়ে দিনের পর দিন তারা  শাসিয়ে গেল। সে এক নিদারুণ সময়পট।

এই পটভূমিটাই কিশোর একটি ছেলেকে বিপথে চালিত করার পক্ষে যথেষ্ট। যে ছেলেটি প্রায় চোখের সামনে বাবাকে খুন হতে দেখে তার জীবন সহজ খাতে বইতে পারে না। কারণ, তার মানসিক যন্ত্রণাটা, ক্ষতটা অন্য আর-পাঁচটা কিশোরের চেয়ে আলাদা। তবুও, নিজের জীবনকে পিনাকী সহজ পথে বইয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন, মায়ের প্রবল ব্যক্তিত্বের জোরে এবং তাঁর ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথের ‘সকল কাঁটা ধন্য’ করার মন্ত্র মাথায় নিয়ে।

বাবা অমল ঠাকুর ছিলেন ডানলপ কোম্পানির শ্রমিক। শ্রমিক নেতা। আদর্শবাদী নেতা। কর্মীবন্ধুদের পাশে বিপদে-আপদে দাঁড়াতে গিয়ে অনেকসময়ই মাইনের টাকা বাড়িতে ঢুকত না। মাও ছিলেন সেই রকম। সংসারের টানাটানিতেও কোনদিন এই নিয়ে তাঁর কোন অনুযোগ ছিল না। বাবা ছিলেন একেবারেই বইপাগল একটা মানুষ। অসম্ভব পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। খাবার সময়ও বাঁ-হাতে ধরা থাকত কোন-না-কোন বই। খেতে খেতেই পড়তেন। পিনাকীর যখন অক্ষর পরিচয়টুকুও হয়নি, তখনই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়ে গেল। বাবা-ই পরিচয় করালেন। আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। কেননা, বাবা ভারি চমৎকার আবৃত্তি করতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। বাবার কণ্ঠে সেই আবৃত্তি শুনতে কী যে ভালো লাগত পিনাকীর! এমনি করেই তিনি বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, আর রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পেয়েছিলেন কবিতা। বামপন্থী বাবার কাছে ঈশ্বর বলতে একজনই ছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। প্রতিবছর পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে তাঁর ছবিতে ফুলমালা দিয়ে পুজো করতেন।

Pinaki-Thakur

বাবা নিজের পাঠ-পাগলামো শৈশবেই ছেলের মধ্যে যেমন চারিয়ে দিয়েছিলেন, পড়ার বইয়ের বাইরে বই পড়ার অভ্যেস যেমন তৈরি করে দিয়েছিলেন; তেমনি লেখালেখির ব্যাপারেও চরম উৎসাহী করে তুলেছিলেন। মূলত তাঁর উৎসাহেই সেই বয়সে মনের কথা কবিতায় প্রকাশ করতে শিখে গিয়েছিলেন পিনাকী ঠাকুর। সে-সব লেখা হয়তো নিতান্তই কাঁচা হাতের লেখা, তবুও তা পাঠ করে বাবা খুব খুশি হতেন, আরও লেখার উৎসাহ দিতেন। কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে বাবার অনেক রাত হত। ছোট্ট পিনাকী চোখের সমস্ত ঘুম দু’পাশে সরিয়ে রেখে সদ্য সৃষ্টি নিয়ে বাবার অপেক্ষায় উন্মুখ পথ চেয়ে বসে থাকতেন। কারণ, বাবাই ছিলেন তাঁর লেখার প্রথম ও পরম পাঠক। এমনি করে ক্লাস ফোরে পড়ার সময়ই তাঁর বেশ কিছু কবিতা লেখা হয়ে গেল। বাবা একদিন তাঁর এক বন্ধুর কাছ থেকে ভালো বই ছাপানোর খোঁজ নিলেন। ছেলের কবিতার বই ছাপাবেন। সেই নিয়ে তাঁর কী উৎসাহ, কী উদ্দীপনা। কিন্তু হল না। সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে অকালে তাঁকে চলে যেতে হল। তবে যাবার আগে তিনি একটা স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছিলেন, ছেলেকে তাঁর ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথের কোলে বসিয়ে যেতে পেরেছিলেন!

বাবা তো নিহত হলেন। মা একা হয়ে গেলেন। তবু হাল ছাড়লেন না। অসম্ভব লড়াই করে দুই মেয়ে ও পিনাকীকে মানুষ করতে লাগলেন। পিনাকী ভাবলেন, বাবা নেই, এবার কে শুনবে, কার জন্য লিখবেন! মাকে দেখে শিখলেন, আশ্রয় বদলে যায়! শুরু করলেন নিজের জন্য লিখতে, যেমন করে লোকে আত্মার দিনলিপি লেখে। স্কুলে পড়তে পড়তেই ছোটদের পত্রিকা ‘শুকতারা’য় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হল। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার কালেই তাঁর একটি লাল ডায়েরি ভরে উঠল অসংখ্য কবিতায়। স্কুলের কয়েকজন বন্ধু ‘উশীনর’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন বার করেছিলেন। সেই কবিতাভর্তি লাল ডায়েরি প্রায় জোর করেই তাঁর কাছ থেকে নিয়ে তা থেকে নির্বাচিত কবিতা তাঁরা প্রকাশ করতে লাগলেন। এই হল তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশের ইতিহাস।

ইতোমধ্যেই যৌবনে পা দিয়ে তিনি ডানলপে বাবার চাকরিতে জয়েন করলেন। কোম্পানি থেকে তাঁকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠানো হল। কিন্তু তিনি তা কমপ্লিট করতে পারলেন না। লিখতে-পড়তে বসলেই তাঁর মাথায় এসে ভিড় করতে লাগল আলোয় আসতে চাওয়া কবিতার পংক্তিমালা। তারা নেমে আসতে চাইল সাদা পাতায় রঙিন অক্ষরে। তাই পরীক্ষা দেওয়া আর সম্ভব হয়ে উঠল না কিছুতেই। আষ্টেপৃষ্ঠে কবিতা ইতোমধ্যেই তাঁকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল যে, চাকরিও আর ভালো লাগল না। ছেড়ে দিলেন চাকরি। হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ বেকার। অবলম্বণ হল, বাড়িতে বাড়িতে ছেলে পড়ানো। তার মধ্যেই বেশ কিছু সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হল, ‘দেশ’-এও।

Pinaki-Thakur-book

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন ‘দেশ’-এর কবিতা বিভাগ দেখতেন। পিনাকীর লেখা তিনি বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। একদিন তিনিই আগ বাড়িয়ে ডেকে পাঠালেন, পোস্ট কার্ডে লিখলেন, ‘কলকাতায় এলে দেখা করো। আমি সেরকম ভয়াবহ নই’। স্বভাবলাজুক পিনাকী একদা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন বটে, কিন্তু মুখোমুখি হতে সাহস পেলেন না। কাঁচের দরজার বাইরে থেকে সুনীলকে সিগারেট হাতে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে সেখান থেকেই সটান পালিয়ে ফিরলেন বাড়ি। তবে খুব বেশিদিন পালিয়ে পালিয়ে থাকতে পারলেন না পিনাকী, সুনীলের ঐকান্তিক চেষ্টায় অচিরেই দুজনের মধ্যে সখ্যতা তৈরি হল।

চাকরি ছাড়ার পর থেকে বেশ অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে পিনাকী যখন দিন কাটাচ্ছিলেন, সেই সময় সুনীল তাঁর জীবনে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে হাজির হয়েছেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সেই কথা পিনাকী অবশ্য বারে বারেই বলেছেন। ‘আনন্দবাজারে পত্রিকা’, ‘কৃত্তিবাস’-এ তাঁর চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন সুনীলই। পিনাকীর বন্ধুভাগ্য বরাবর ভালো। বন্ধুরা তাঁর কবিতা প্রথম প্রকাশ করেছিল পত্রিকায়। ১৯৯৪ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদিন অশরীরী’ও প্রকাশিত হয়েছিল বন্ধুদের উদ্যোগেই।

কবিতা তাঁকে খ্যাতি দিয়েছিল যথেষ্ট। সেই খ্যাতির পথ বেয়ে ধীরে ধীরে শরীরী আদল পেয়েছিল তাঁর আরও কিছু কাব্যগ্রন্থ—‘হ্যাঁ রে শাশ্বত’, ‘অঙ্কে যত শূন্য পেলে’, ‘চুম্বনের ক্ষত’, ‘শরীরে কাঁচের টুকরো’, ‘নিষিদ্ধ এক গানের মতো’, ‘কলঙ্ক রচনা’ এবং ‘অকাল বসন্ত’। যারা লিখন-খ্যাতির পাশাপাশি এনে দিয়েছিল কিছু পুরস্কারও।

Pinaki-Thakur-Book-002

যাপনের সততা মাখা সহজ আটপৌরে পংক্তিমালায় অদ্ভুত এক মায়া জড়িয়ে টেনে রাখার আশ্চর্য ক্ষমতা পিনাকীর। এই মায়াটাই তাঁর নিজস্ব দর্শন। যেখানে নির্লিপ্ত রয়েছে কিছু সাদামাঠা, কিছু সূক্ষ্ম জীবনবোধ—যা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত। নিজে চলে গিয়েও পিনাকী রেখে গিয়েছেন সেই মায়া কবিতার চরণে চরণে ব্যঞ্জনার নিক্কণে। আমাদের কাউকে কাউকে সেই মায়া এখনও তাড়িত করে শর্বরীর প্রান্তরে, প্রান্তিক জনপদে, তৃষিত করে অবাধে ঘোরায়, ধরায় ভীরু কামিনীর প্রেমে পড়ার নেশাঃ

‘..যেমন নিশি—

পাওয়া মানুষ শয্যা ছেড়ে রাতবিরেতে পাগলপারা

বনবাদাড়ে জলা, ডাঙায় ঘুরছে—শুধু ঘুরেই সারা

তেমন ক’রে বাসছি আবার, বাসব ভালো প্রথম থেকে

আবছা হাসির প্রশ্রয় দাও, নাম কী বলো, পাড়ার কে কে

বই টুকে প্রেমপত্র পাঠায়?

ওদের সঙ্গে ডুয়েল ল’ড়ে

বাসবো, তুমি একলা দাঁড়াও—

ভালোই বাসবো নতুন ক’রে’

[‘একলা দাঁড়াও’ কবিতা।]

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...