ফণী মজুমদারঃ বলিউডের বিখ্যাত বাঙালি পরিচালক

মুখে হাসি, চোখে মোটা কাঁচের চশমা। পরনে ধুতি-শার্ট। ছয় ফুট লম্বা। যেমন স্বাস্থ্য, তেমনি সুন্দর চেহারা। আর তেমনই শিক্ষিত-মার্জিত, মৃদু ও ধীর কথার মানুষ তিনি। যিনি পেয়েছিলেন একইসঙ্গে দীর্ঘ ও কর্মঠ জীবন; সেই মানুষটি অসাধারণ এক চিত্রপরিচালক। নাম, ‘ফণী মজুমদার’। ১৯৯৪ সালে তিরাশি বছর বয়সে তিনি যখন মারা গেলেন, তখনও কাজ করে চলেছিলেন দূরদর্শনের জন্য। বাঙালি হয়েও বলিউডে যারা বাদশার মতো সম্মান নিয়ে রাজত্ব করেছেন, ফণী মজুমদার তাঁদের অন্যতম। শুধু তাই নয়, ন’টা আলাদা আলাদা ভাষায় ছবি করার কৃতিত্বও তাঁর ঝুলিতে।

পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরের ছেলে ফণী। ছায়াছবির জগতে তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর হাত ধরে। না, ছায়াছবির কাজ শিখতে তিনি আসেননি, ১৯৩০ সালে কারমাইকেল কলেজ থেকে স্নাতক হবার পর নিউ থিয়েটার্স-এ জয়েন করেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়ার টাইপিস্ট কাম স্টেনোগ্রাফার হিসেবে। তারপর বাকিটা সঙ্গগুণ। তখন নিউ থিয়েটার্স-এ নতুন ভাবনা, নতুন ধরণের আলোক প্রক্ষেপণের চমৎকারিত্ব নিয়ে ছবি করে দেশ মাতাচ্ছেন প্রমথেশ বড়ুয়া। তাঁকে দেখে সাধ হল এই নতুন মাধ্যমটি আত্মস্থ করার। কাজেই কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বড়ুয়া সাহেবের সহকারীদের একজন হয়ে উঠলেন।

সেই সঙ্গে ১৯৩৭ সালে একদিন প্রফুল্ল রায়ের ‘অভিজ্ঞান’ ছবির জন্য চমৎকার একখানা স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললেন। প্রমথেশ কারও মধ্যে ভালো গুণ দেখলে কাজে লাগাতেন। ফলে তাঁকে দিয়ে অমনি লিখিয়ে নিলেন ‘মুক্তি’ সিনেমার চিত্রনাট্য। ছবিটি অসম্ভব সফল হতেই ছুটতে শুরু করল ফণীর গৌরবের রথ।

অল্প সময়েই পরিচালনা ও চিত্রনাট্যরচনার কাজে ফণী মজুমদার এমন দক্ষতা অর্জন করলেন যে, নিউ থিয়েটার্স তাঁর ওপর অচিরেই ভরসা করল এবং ১৯৩৮ সালে তাঁকে স্বাধীনভাবে চিত্রপরিচালনার সুযোগ দিল। ফণী সেই সুযোগ গ্রহণ করলেন। পরিচালনা করলেন হিন্দি-বাংলা দ্বিভাষিক ছবি কে এল সায়গলকে ও কানন দেবীকে নায়ক-নায়িকা হিসেবে নিয়ে। ছবিটির বাংলা নাম, ‘সাথী’; হিন্দি নাম, ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই ছবিটি ব্যাপক সাফল্য লাভ করল। ছবির ‘বুলবুল মোরা নাইহার ছুট যায়’ গানটি ফিরতে লাগল লোকের মুখে মুখে।

‘স্ট্রিট সিঙ্গার’-এর সাফল্যের পর একটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। কলকাতায় ১৯৩৯ সাল নাগাদ ব্যাপক কলেরার প্রকোপ শুরু হল, যা অল্পদিনেই মহামারীর আকার ধারণ করল। এই সময় নেহেরু এলেন কলকাতায়। তিনি বি এন সরকারের সঙ্গে দেখা করে কলেরা-পরিস্থিতির ওপর এমন একটি ছবি তৈরি করতে অনুরোধ করলেন, যা দেখে মানুষ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে। পরিচালক হিসেবে ফণী এরইমধ্যে অত্যন্ত সুনাম অর্জন করেছিলেন, তাই তাঁরই ওপরই সেই ছবির দায়িত্ব দিলেন সরকারমশাই। সুতরাং বিলেত পড়ুয়া ডাক্তার গ্রামে ফিরে গ্রামের আর্ত ও কলেরাপীড়িত মানুষের সেবার ব্রত তুলে নিচ্ছে-এই থিমে লেখা শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘ডাক্তার’ অবলম্বনে তিনি ঐ নামেই তড়িঘড়ি একখানা ছবি তৈরি করে ফেললেন। তাড়াতাড়িতে তৈরি হলেও যত্নের অভাব হল না।

তাই ১৯৪০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ডাক্তার’ ছবিটিকে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত আদরের সঙ্গে গ্রহণ করলেন এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সুযোগ পেলেন। এই ছবিটিই ১৯৫৮ সালে ফণী মালয়-ভাষায় রিমেক করেন। আরও পরে ১৯৭৭ সালে তাঁরই সুযোগ্য শিষ্য শক্তি সামন্ত ‘আনন্দ আশ্রম’ নামে আবার তা রিমেক করেন।    

যাই হোক, সাফল্যের পথ বেয়ে ১৯৪১-এ ডাক এল বম্বে থেকে। ফণী সেই ডাকে সাড়া দিলেন। এসে জয়েন করলেন ‘বম্বে টকিজ’ স্টুডিওতে। তিনি অল্পদিনেই কলকাতার সিনেমা-জগত জয় করে ফেলেছিলেন, বম্বে এসেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। অচিরেই হয়ে উঠলেন সকলের প্রিয় ‘ফণীদা’। একে একে পরিচালনা করলেন ‘তামান্না’ (১৯৪২), ‘মোহাব্বত’ (১৯৪৩), ‘আন্দোলন’ (১৯৫১), ‘উঁচে লোগ’ (১৯৬৫)-এর মতো বিখ্যাত সব ছায়ছবি।

দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবনে ফণী মজুমদারের অনেকগুলো মাইলস্টোন রয়েছে। অনেক স্টার, অনেক চিত্রপরিচালক তাঁর হাতে তৈরি হয়েছেন। জীবন ও সমাজের অনেক সমস্যা তাঁর হাতেই প্রথম চিত্ররূপ পেয়েছে। তাঁর ছায়াছবির সরণিতে ‘উঁচে লোগ’ (১৯৬৫)একটি বহুল প্রশংশিত ছবি। এই ছবির জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ‘সার্টিফিকেট অব মেরিট’ পান। এবং এই ছায়াছবিতে অভিনয় করেই ফিরোজ খান চলচ্চিত্রের নায়ক ও ভালো অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। আসলে হিন্দি ছায়াছবির নাচগানধারার বাইরে খেটেখাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনও এই সময় উঠে আসে তাঁর ছবিতে। তাঁর ‘বাদবাঁ’ (১৯৫৪) ছবিতে তিনি তুলে ধরেন সামুদ্রিক জেলেদের জীবনগাথা। ‘বাদবাঁ’‘ধোবি ডক্টর’ ছবিতে তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ শেখেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত প্রযোজক ও চিত্রপরিচালক শক্তি সামন্ত। তাঁর ‘আরতি’ (১৯৬২) ছবিতে অভিনয় করে মীনা কুমারী হয়ে ওঠেন দারুণ বিখ্যাত। তাঁর ‘ইন্সাফ’, ‘হাম ভি ইন্সান হ্যায়’, ‘আন্দোলন’–প্রভৃতি সামাজিক সমস্যাকে বলিষ্ঠভাবে চিত্রায়িত করে আজ ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে।

ফণী শুধু বাংলা, হিন্দি, পাঞ্জাবি, আওধি প্রভৃতি ভারতীয় ভাষার চিত্রপরিচালক হিসেবেই নিজেকে আটকে রাখেননি। তিনি বিদেশের আমন্ত্রণে বিদেশের মাটিতে থেকে বিদেশি ভাষায় ছবি তৈরির বিরল সম্মান অর্জন করেছিলেন। সিঙ্গাপুরের শ’ ব্রাদার্স মালয় ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানির আমন্ত্রণে তিনি ছ’বছর সেখানে থেকে আটখানা ছবি পরিচালনা করেন। আসলে তাঁর আগেও বেশ কয়েকজন ভারতীয় চিত্রপরিচালক সেখানে গিয়ে ছবি পরিচালনা করে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁদের পরিচালিত ছবি কোম্পানির পছন্দ হয়নি। কারণ, তা বলিউডের মালয় ভারসান হয়েছিলমাত্র, ওদের ছবি হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ফণী ওদের সংস্কৃতি ও জীবনচর্যাকে অনুধাবন করে ওদের মতো করেই ছবি বানালেন ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে। ছবির নাম, ‘হাং তুয়াহ’। ছবিটি মালয়ভাষী মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে গৃহীত তো হয়েইছিল, সেই সঙ্গে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কারের জন্যও নমিনেট হয়েছিল। বলা বাহুল্য, সে এক বিরল সম্মান। বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের এই পরিচালক তাঁর চিত্রকর্ম দিয়ে শুধুমাত্র বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেননি, করেছেন বিশ্বের কাছে স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল। তাই ভারতীয় তথা বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘ফণী মজুমদার’ একটি গৌরবময় অধ্যায়ের নাম।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...