" ...সারা দুনিয়াই নাচছে। এই দেখুন না, বাতাস নাচছে, চাঁদ নাচছে, পৃথিবী নাচছে, পাতা নাচে, ফুল নাচে। কৃষ্ণ বাঁশি বাজায়, শিব ডমরু বাজায়, নাচে তো বটেই।"পন্ডিত বিরজু মহারাজের এই অনুভব মনে পড়িয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের গানের ছত্রটি-"নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ, নৃত্যে তোমার মায়া/ বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া।"
বিরজু মহারাজের কাছে নাচ-কত্থক নাচই ছিল জীবন। বছর কয়েক আগে এক অনুষ্ঠানে ছোট ছেলেমেয়েরা তাঁকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানালে তিনি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন তারা কত্থক নাচ সম্পর্কে কিছু জানে কী না। তখন আট বছরের এক বালিকা তাঁকে বলেছিল," কত্থক হল সেই নাচ যা বিরজু মহারাজ নাচেন।" বালিকা তাঁকে চিনত না। তার এই সরল উক্তি শুনে বিরজু মহারাজ তাকে বলেছিলেন," বিরজু মহারাজ কত্থক নাচেন না, তিনি ওই নাচেই বেঁচে থাকেন।" দীর্ঘ সময় ধরে এই উপমহাদেশে বিরজু মহারাজ আর কত্থক এক আশ্চর্য অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল।
১৯৩৭ মতান্তরে ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখে পরাধীন ভারতের যুক্তপ্রদেশের হান্ডিয়ায় বিরজু মহারাজের জন্ম হয়। তাঁদের পারিবারিক পদবী মিশ্র। প্রথমে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল দুখহরণ। পরে পাল্টে রাখা হয় ব্রিজমোহন নাথ মিশ্র। কথকের বোল, তাল আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুর জড়িয়ে ছিল তাঁর পরিবারে। কত্থক নৃত্য শৈলীর সর্বজনমান্য শিক্ষক, পন্ডিত ঈশ্বরীপ্রসাদের বংশধর ছিলেন বিরজু মহারাজ। কথিত আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বপ্নে তাঁকে আদেশ দিয়েছিলেন কত্থক নাচকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দিতে।
সেই কারণেই ঈশ্বরীপ্রসাদ তাঁর সন্তানদের কথকের তালিম দেন। এঁদেরই বংশধর বিন্দাদিন, কালকাপ্রসাদ ও ভৈঁরোপ্রসাদ মহারাজ। বিরজু মহারাজের ঠাকুর্দা কালকাপ্রসাদ এবং তাঁর ভাই বিন্দাদিন মহারাজ ছিলেন প্রখ্যাত কত্থক নৃত্য শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ। বিন্দাদিন ছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর সভাগায়ক ও রাজনর্তক। এঁরা দুই ভাই মিলেই কালকা-বিন্দাদিন ঘরানা, যা কি না লক্ষ্ণৌ ঘরানার পরিমার্জিত রূপ, তা সৃষ্টি করেছিলেন। কালকা মহারাজের পুত্র জগন্নাথ ওরফে অচ্ছন মহারাজ ছিলেন বিরজু মহারাজের বাবা ও প্রথম গুরু। শৈশব থেকে নাচের বাইরে তাঁর কোনও জীবন ছিল না। মাত্র দু বছর বয়েস থেকে তিনি নাচতে শুরু করেন। নিজেই বলেছেন, "নাচ আমার রক্তে, আমার চেতনায়। সঙ্গীতও তাই। বাবার কোলে বসে আমি নাচের বোল মুখস্ত করেছিলাম"। মনে পড়ে যায় পৃথিবীর আর এক প্রান্তের আর এক অবিস্মরণীয় নৃত্যশিল্পী ইসাডোরা ডানকানের উক্তি, "If people ask me when I began to dance I reply, 'In my mother's womb, probably as a result of the oysters and champagns- the food of Aphrodite."
নিতান্ত শৈশব থেকে তিনি কত্থককে কেন্দ্র করেই বড় হয়ে উঠেছিলেন। ছেলেদের যখন মাঠে খেলার বয়েস তখন থেকে তিনি কথকের অনুশীলন করেছেন। নাচ ছিল তাঁর খেলা, তাঁর অবসরযাপন-সব। প্রথম মঞ্চানুষ্ঠান বাবা-কাকাদের পথ ধরে। সাত বছর বয়েসে কলকাতায় তাঁর প্রথম একক নৃত্যানুষ্ঠানে শ্রোতারা তাঁর যে তারিফ করেছিল তা তিনি কখনও বিস্মৃত হন নি। কলকাতাতেই তিনি জীবনের প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন। তখন তিনি ব্রিজমোহন নাথ মিশ্র। এই পরিচয় থেকে পন্ডিত বিরজু মহারাজ হয়ে ওঠার পথটি খুব মসৃণ ছিল না।
বিরজু মহারাজের বাবা অচ্ছন মহারাজ দিল্লির 'সঙ্গীত ভারতী'-তে নৃত্যগুরু পদে যোগ দিয়ে সপরিবারে দিল্লি চলে যান। তাই ছোট থেকেই তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সব কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই সময় থেকে নাচ, গান ও তবলা বাজানোয় তাঁর দক্ষতার প্রকাশ হতে থাকে। দিল্লিতে দাঙ্গা দেখা দিলে অচ্ছন মহারাজ পরিবার নিয়ে লক্ষ্ণৌ চলে যান। এরপর তাঁর মৃত্যু হলে পরিবারটি আর্থিক সমস্যায় সম্মুখীন হয়। এই পরিস্থিতিতে বিরজু মহারাজ মুম্বইতে তাঁর কাকা লাচ্চু মহারাজের কাছে টানা দশ বছর শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর দুই টাকা লাচ্চু মহারাজ ও শম্ভু মহারাজের কাছেই তিনি তালিম নিয়েছেন।
মাত্র তেরো বছর বয়সে বিরজু মহারাজ দিল্লির 'সঙ্গীত ভারতী'-তে কত্থক শেখাতে শুরু করেন। পাশাপাশি চলতে নিজের তালিম ও। ধীরে ধীরে শাস্ত্রীয় নৃত্যের নিয়মনিষ্ঠতার মধ্যে থেকেও তিনি নিজস্বতা খুঁজে পেতে থাকেন। তাঁর নাচে ফুটে উঠতে থাকে নিজস্বতার সাক্ষর। এরপর 'কত্থক কেন্দ্রে' প্রথমে কাকার সঙ্গে, পরে নিজেই শেখাতে শুরু করেন। সঙ্গীত নাটক একাডেমির একটি শাখা 'কত্থক কেন্দ্র'-র ডিরেক্টর পদ থেকে ১৯৯৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তাঁর নিজের শিক্ষাঙ্গন 'কলাশ্রম' প্রতিষ্ঠা করেন।
কত্থক নৃত্যের মূলত তিনটি ঘরানা- লক্ষ্ণৌ, বেনারস আর জয়পুর। লক্ষ্ণৌ ঘরানার বৈশিষ্ট্য অভিনয়ের মাধ্যমে ভাব প্রকাশ। সেই অভিনয় অংশে বিরজু মহারাজের অসাধারণ দাপট ছিল। কত্থক মানে যে শুধু পরণ আর চক্কর নয় তা তিনি দেখিয়েছিলেন। প্রতিটি উপস্থাপনা তাঁর কাছে ছিল নতুন ক্যানভাসে নতুন ছবি আঁকা।তিনি জানতেন যখন তিনি মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করছেন তখন দর্শক ব্যক্তি বিরজু মহারাজকে দেখে না, দেখে শিল্পী বিরজু মহারাজকে, দেখে তাঁর উপস্থাপনাকে। তাই মঞ্চ ছিল তাঁর পূজাঘর, উপস্থাপনা পূজা।
নাচের সঙ্গে তাঁর তালিম ছিল গানেও।তিনি পাখোয়াজ, তবলা, সরোদ, সেতার, বাঁশি, বেহালা, সারেঙ্গি ইত্যাদি নানান যন্ত্রও বাজাতে পারতেন। উস্তাদ আমির খাঁ সাহেব, পন্ডিত রবিশঙ্কর প্রমুখ গুণীজনের সঙ্গে তিনি তবলা সঙ্গত করেছেন। উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর এমনই দখল ছিল যে সত্যজিৎ রায় তাঁর 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি' চলচ্চিত্রে "কানহা ম্যায় তোসে হারি" ঠুংরিটি তাঁকে দিয়েই গাইয়েছিলেন। গানটির সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন বিরজু মহারাজের সুযোগ্যা ছাত্রী শাশ্বতী সেন।
তিনি মুম্বইতে একাধিক চলচ্চিত্রে নাচের কোরিয়োগ্রাফি করেছেন। 'উমরাওজান', 'গদর: এক প্রেমকথা', 'দিল তো পাগল হ্যায়','দেবদাস','বিশ্বরূপম্','বাজিরাও মাস্তানি', 'কলঙ্ক' ইত্যাদি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনবত্বের সাক্ষর রেখেছেন। চলচ্চিত্রে তাঁর সব কোরিয়োগ্রাফিতে তিনি কথকেরই বিস্তার করেছেন। 'বিশ্বরূপম্' ছবির জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। 'বাজিরাও মাস্তানি' ছবি তাঁকে শ্রেষ্ঠ কোরিয়োগ্রাফির জন্য ফিল্মফেয়ার সম্মান এনে দিয়েছিল।
মাত্র ২৮ বছর বয়েসে বিরজু মহারাজ সঙ্গীত নাটক একাডেমির সম্মান পেয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে পদ্মবিভূষণ ও এরপর কালিদাস সম্মান,লতা মঙ্গেশকর পুরস্কার, সঙ্গম কলা পুরস্কার, ভরতমুনি সম্মান, অন্ধ্ররত্ন, নৃত্যবিলাস, জাতীয় নৃত্য শিরোমণি, রাজীব গান্ধী জাতীয় সদ্ভাবনা পুরস্কার ইত্যাদি বহু পুরষ্কারে তিনি ভূষিত হয়েছিলেন।ইন্দিরা কলা সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছিল সাম্মানিক ডক্টরেট।
শিল্পের নানা অঙ্গনে তাঁর ছিল স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তিনি কবিতাও লিখতেন, এঁকেছেন ছবিও। তিনি এমন একজন শিল্পী ছিলেন যিনি ছক ভাঙাতেই আনন্দ পেতেন।একবার চেন্নাইতে তাঁর অনুষ্ঠানে যাঁর গান গাওয়ার কথা তিনি সময়মতো আসতে না পারায় তিনি প্রখ্যাত ভরতনাট্যম শিল্পী বালাসরস্বতীকে তিলানা গাইতে অনুরোধ করেন এবং দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতের সুরে ও তালে কত্থক পরিবেশন করে দর্শকদের মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছিলেন।
বিরজু মহারাজ বিশ্বাস করতেন কত্থক শিল্পী মানেই কথাকার। কত্থক নৃত্যশৈলীই তো এসেছে কত্থকতা বা কথা থেকে। তাই একজন কত্থক শিল্পীর কাজ তাঁর সমকালকে নাচে ধরে রাখা। তিনি তাঁর নাচে চিরকালীন ভাবনার পাশাপাশি স্থান দিয়েছেন সমসময়কে। এমনকি সরকারি দপ্তরের দীর্ঘসূত্রিতাকে নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন 'ফাইল কথা'।
একদিকে প্রাচীন কথাকারদের উত্তরসূরী হিসেবে তিনি ছিলেন অনবদ্য। দৈনন্দিন জীবনের নানা তুচ্ছ ঘটনাতেও তিনি খুঁজে পেতেন নাচের ছন্দ। আর অন্যদিকে নিজেকে নিত্যনতুন ভাবে দর্শকদের সামনে উপস্থাপনা করায় ছিল তাঁর আশ্চর্য আনন্দ। ওড়িশি নৃত্যের দিকপাল শিল্পী কেলুচরণ মহাপাত্রের সঙ্গে পন্ডিত বিরজু মহারাজের অনবদ্য যুগলবন্দী আজও প্রবীণ দর্শকদের স্মৃতিতে ভাস্বর। সেখানে বিরজু মহারাজ কৃষ্ণ এবং কেলুচরণ মহাপাত্র রাধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
দেশ-বিদেশের নানান অঙ্গনে তিনি তাঁর অনন্য নৃত্য কুশলতার সাক্ষর রেখেছিলেন। ছোটবেলায় বাবা-কাকাদের সঙ্গে ভারতের নানান অঞ্চলে এবং পরবর্তীতে বিদেশের নানা প্রান্তে কত্থক নৃত্যকে, 'কালকা- বিন্দাদিন ঘরানা'-র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নৃত্য শৈলীকে তুলে ধরেছেন। ভারতীয় নৃত্যধারার প্রতিভূ হয়ে তিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, জাপান, ইংল্যান্ড,ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, অস্ট্রিয়া, বাংলাদেশ ইত্যাদি নানা দেশে কথকের অভিনব পরিবেশনায় দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন হৃদয়ের কম্পনই তো নাচ। মানুষের অন্তরে নাচ, বাহিরে নাচ। এই নাচ কেউ খুঁজে পায়, কেউ পায় না। এই বিপুল তরঙ্গ তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তাঁর নাচ এত মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছিল।
সুরে ছন্দে তাঁর জীবন ছিল বাঁধা। তাই সুরের মধ্যেই তিনি বিদায় নিলেন এই মরজগত থেকে। নাতনী আর শিষ্যারা যখন অন্তাক্ষরী খেলছিল তখন সেই ঘরে খাটে শুয়ে গান শুনতে শুনতে হাসছিলেন তিনি। হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন বিরজু মহারাজ। অসুস্থ তিনি ছিলেন। কিডনির সমস্যার জন্য চলছিল ডায়ালোসিস। সেই গভীর শীতের রাতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল দিল্লির সাকেত হাসপাতালে। কিন্তু তাঁর যে আরও তাড়া ছিল। তাই চলে গেলেন। ২০২২ -র ১৭ জানুয়ারি রবিশঙ্কর যাঁকে "লয়ের পুতুল" বলে অভিহিত করেছিলেন সেই লয় স্তব্ধ হল। ৮৪ বছরের মাত্রা সাঙ্গ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন পন্ডিত বিরজু মহারাজ।
পন্ডিত বিরজু মহারাজজীর জন্মদিবসে তাঁর পুত্র দীপক মহারাজ এবং প্রিয় শিষ্য সৌভিক চক্রবর্তীর শ্রদ্ধার্ঘ্য
দীপক মহারাজ (পুত্র)
সৌভিক চক্রবর্তী (শিষ্য)