জসীম উদ্দীনের কবিতার পথ

‘নকশী কাঁথার মাঠ’ আর ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যের সুবিখ্যাত কবি জসীম উদ্দীন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সহজ ছন্দের কবি। আর তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, সহজ গতির কবিতা। তাই সেই কবিতাবলীর সহজ আবেদন মানুষকে আজও কাঁদায়, রসবিমোহিত করে। 

যদিও, সাহিত্যের দরবারে এই রসসিদ্ধ সহজ ব্যাপারটা বড় দুষ্প্রাপ্য জিনিস। তাকে আয়ত্ত করা কারও পক্ষে প্রভূত কষ্টসাধ্য, কারও কাছে সে অধরা মাধুরী। এই সাহিত্যগুণটি ফরিদপুরের সন্তান জসীম উদ্দীন কীভাবে আয়ত্ত করেছিলেন, তাই নিয়ে বেশ মধুর একখানা গল্প আছে, সেটাই বলছিঃ

জসীম যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, তখন তাঁর একখানা স্যাঙাৎ জুটল, মনু, অর্থাৎ মনোরঞ্জন। সে একেবারে যাকে বলে প্রানের বন্ধু। মনু হলেন এস ডি ও-সাহেব বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্যের ছেলে। তাঁরা শিক্ষিত ও রুচিশীল বড়লোক। ফলে, বাড়িতে ছোটদের পড়ার মতো অনেক বইয়ের লাইব্রেরি ছিল। কলকাতার কিছু বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকাও নিয়মিত আসত। তার মধ্যে সেরার সেরা কিশোর-পত্রিকা ‘সন্দেশ’-ও ছিল। 

তা, সে-সব পড়তে পড়তে সাহিত্যের রসসাগরে ডুবতে ডুবতে দুই বন্ধু পরামর্শ করতে লাগলেন যে, বড় হয়ে একদিন সাহিত্যিক হতে হবে, এমনি সুন্দর সুন্দর গল্প লিখতে হবে, পদ্য লিখতে হবে। কিন্তু, কীভাবে সাহিত্য করা যাবে বা সাহিত্যিক হওয়া যাবে তা তো দু’জনেরই জানা নেই। এখন বড়দের কাছে এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে যদি হাসিঠাট্টার পাত্র হতে হয়! তার চেয়ে থাক বাবা, খানিক রয়ে-সয়ে সুযোগ বুঝে একটু একটু করে জেনে নিলেই হবে। কাজেই শুরু হল সুযোগ সন্ধানে অপেক্ষার পালা।  

 

সে-সময়ই একদিন চাচার বিয়ে দিতে জসীম শ্যামসুন্দরপুর গেলেন বরযাত্রীদের সঙ্গে। পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হল। 

সবার যখন খানাপিনায় মন, তখন জসীমের কান শুনতে পেল আবছা ঢাকের বাজনা। জিজ্ঞেস করে জানলেন, দূর গাঁয়ে জমিদারের কাছারিতে কবির লড়াই হবে। যেই না শোনা, অমনি সে লড়াই দেখার জন্য মন উদগ্রীব হল। খাওয়া-দাওয়ার কথা মাথায় উঠল। বাজনা অনুসরণ করে চাঁদের আলোয় মাঠঘাট পেরিয়ে একা জসীম পৌঁছে গেলেন জমিদারের কাছারিতে।

কাছারিতে তখন কবিগান জমে উঠেছে। এক কবি যমের হয়ে, অন্যজন সতী সাবিত্রীর হয়ে তাৎক্ষণিক গান বেঁধে চোখা চোখা প্রশ্ন ও উত্তরে আসর জমিয়ে ফেলেছেন। 

আসরে দাঁড়িয়ে এই যে সঙ্গে সঙ্গে গান বেঁধে সুরের ছাঁচে ফেলে কবিগানের এগিয়ে চলার রীতি, এটাই দারুণ মনে ধরে গেল জসীমের। কানে আর প্রানে বসে গেল সুর। হৃদয়ে অনুরণন তুলল। ডাঁসা ফলে যেমন একটু একটু করে বরণ ধরে, তেমনি করে তাঁর মনে রঙ লাগতে শুরু করল। গানের ক’টি কলি ভ্রমরের মতো কেবলই গুঞ্জন তুলতে লাগল অন্দরেঃ

 

‘ওহে যম রাজা! তুমি আমারে মন্দ বলো না।

তারে নারে নাইরে নারে, নারে নারে নারে নারে,

নাইরে নারে নারে নারে নাইরে নারে নারে না,

     তুমি আমারে মন্দ বলো না।’

 

কাছারি থেকে বিয়েবাড়িতে এসে তো বটেই, এমনকি বিদায়ের পর বরকনের পাল্কির পেছন পেছন হেঁটে আসার সময়ও মনের আনন্দে বার বার গানটি গাইতে লাগলেন। তাল-মাত্রা-ছন্দের দোলায় নাচতে নাচতে চলতে লাগলেন। সেই দোলায় তাঁর অবচেতন মন ছন্দের মাত্রা বুঝতে পেরে গেল। একটা বোধ তৈরি হল। তখন পরিচিত কথাগুলো বাদ দিয়ে সেই গানের সুরেই অন্য কথা বসাতে শুরু করলেন। আর সুন্দরভাবে সেটা পারলেনও। তখন ভারি আনন্দ হল।

Jasimuddin1

নতুন কিছু শিখতে পেরে, সৃষ্টির আনন্দ অনুভব করতে পেরে দিনরাত চলতে লাগল একইসুরে নতুন নতুন গান বানানোর খেলা। একটা সময় দেখলেন, দৈনন্দিনের কথা ও দেখাকে আর সুরে বাঁধতে অসুবিধে হচ্ছে না। সুরের ধারায় কথার পরে কথার মিল আসছে আপনিই।

এমনি করে কেটে গেল সাত-আটটা দিন। গাঁয়ের তাঁতিপাড়ায় রহিম মল্লিক তাঁত চালানোর পাশাপাশি কবিগানও গাইতে পারেন। জসীম গেলেন তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে। জসীম তাঁকে ডাকেন, ‘চাচা’। 

চাচা জসীমের হবু-শাশুড়িকে নিয়ে মস্করা করে গান ধরলেন, আর জসীম চাচার হওয়া-শাশুড়িকে নিয়ে মস্করা করে উত্তর দিতে লাগলেন। টরেটক্কা টক্কর চলতে লাগল। তাতে মজা এমন জমে উঠল যে, চাচি হেসে লুটোপুটি খেতে লাগলেন।

এরপর থেকে কবিগান জসীমকে একেবারে নেশার মতো পেয়ে বসল। আশপাশের গাঁয়েগঞ্জে যেখানেই কবিগানের আসর বসে, সেখানেই তিনি ছুটে যেতে লাগলেন। কবিগানের আসর থেকে নানান ছন্দে মুখে মুখে গান তৈরির শিক্ষা পেতে লাগলেন। গাঁয়ে-ঘরে যাঁদের কবিগানের শখ, তাঁদের সঙ্গে যখন-তখন গানের লড়াইয়ে মেতে উঠতে লাগলেন। 

মাঝে মাঝেই বড়মানুষের সঙ্গে একটা সাত-আট বছরের বাচ্চাছেলে পাল্লা দিয়ে লড়াই করছে দেখে, ভিড় জমে যায়। লোকেরা তারিফ করে, ‘ছেলেটা বেঁচে থাকলে বড় কবিয়াল হবে’। তাই শুনে ছোট্ট জসীমের উৎসাহের অন্ত থাকে না। মনে মনে ঠিক করে ফেলেন, হ্যাঁ, কবিয়াল, কবিয়ালই হতে হবে একদিন! নতুন সাধের তলায় কবি-সাহিত্যিক হবার সাধটি সাময়িক ঢাকা পড়ে যায়, শিশু-কিশোরের মন, যেমন হয় আর কী...

ইতোমধ্যে জসীমদের স্কুলে এলেন একজন নতুন শিক্ষক। নাম, ক্ষীরোদবাবু। জসীম জানতে পারলেন, মাস্টারমশাই আসলে একজন কবি। অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখতে পারেন। 

ব্যস, তাঁর মনে ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠল কবি হওয়ার সাধ। ইচ্ছে হল, এঁর কাছেই জেনে নিতে হবে কবিতা রচনার কলাকৌশল। অমনি ছুটলেন ক্ষীরোদবাবুর কাছে। তিনি খুব উৎসাহের সঙ্গে জানালেন যে, কেমন করে চোদ্দ অক্ষর গুণে গুণে পয়ার ছন্দে কবিতা লিখতে হয়। তারপর শোনালেন নিজের লেখা কয়েকটি সুন্দর সুন্দর কবিতা।

ক্ষীরোদবাবুর কাছ থেকে ফিরে জসীমের মনে হল, এখনই একটা কবিতা লিখতে হবে, এক্ষুনি। কিন্তু, খাতা-কলম নিয়ে কবিতা লিখতে বসে চোদ্দ অক্ষর গুণতে গিয়ে ছন্দ মেলাতে গিয়ে দেখলেন ভাব আসছে না, কথাও আসছে না। এখন কী করা, কবিতা যে লিখতেই হবে! নইলে যে স্বস্তি নেই! 

অনেক ভেবে একটি উপায় পেলেন। বাবার একটি ছেঁড়া বই আছে, তাতে অনেকগুলো ঈশ্বর-আল্লা বিষয়ে কবিতা আছে। তা থেকে সহজ মতো একটি কবিতা বেছে নিয়ে লাইনগুলো এদিক-ওদিক করে শব্দের হেরফের ঘটিয়ে একখানা কবিতা খাড়া করে ফেললেনঃ

‘তুমি ভীম-ভবার্ণবে ভাসিবার ভেলা,

তোমাকে প্রণামকালে করি অবহেলা।’ ইত্যাদি।

চুরি বিদ্যে বড় বিদ্যে, যদি না-পড়ো ধরা। না, ধরা পড়লেন না। কারণ, একে তিনি কবিতাটি কেবল শোনালেন গিয়ে তাঁর ক্লাসের বন্ধুদের, তার ওপর তাদের বিদ্যের দৌড় যেটুকু, তাতে তাদের পক্ষে বোঝার কোন উপায়ই ছিল না কবিতাটি কোন অনুপ্রেরণায় তৈরি। ফলে, কবিতাটি শুনে এবং সেটি জসীমের লেখা জেনে তারা তাজ্জব হয়ে গেল।

একটা কবিতা নিয়ে আর ক’দ্দিন চালানো যায়। ক্লাসের কবিখ্যাতি অক্ষুন্ন রাখতে নতুন কবিতা লেখার প্রয়োজন পড়ল। বাবার ছেঁড়া বইটিতে টুকবার মতো সহজ কবিতা আর দ্বিতীয়টি ছিল না। জটিল কবিতা জসীমের পছন্দ নয়। কারণ, একে অন্যে শুনে কিছু বুঝবে না, তার-ওপর সব শব্দের মানে তিনিও জানেন না, ওরা জিজ্ঞেস করলে মানে বলতে না-পারলে একটা কেলেঙ্কারি হবে। সুতরাং, টোকা এবং অনুকরণ বাদ। জোরকদমে ফের চেষ্টা শুরু করলেন নিজেই কিছু লিখতে।

কিন্তু, না, এবারও কথা যোগাচ্ছে না। নদীর ধারে নির্জনে বসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে, ফুলের দিকে চেয়ে, কিছুতেই ভাব আসছে না। শুধুই ভাবনা হচ্ছে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। অবস্থা যখন হতাশার চূড়ান্তে উঠল, তখনই তাঁর মাথায় হঠাৎ করে একটা আলোর রেখা খেলে গেল।

তিনি তো গানের সুরে সুন্দর ও লাগসই কথা বসাতে পারেন, কবিগানের বোল তৈরি করতে পারেন যখন-তখন যে-কোন বিষয় নিয়ে—সেও তো মুখে মুখে তৈরি কবিতা। সেভাবে কবিতা তৈরি করলে হয় না? সেটাই খাতায় লিখে কেমন দাঁড়ায় একবার দেখা যাক তো! 

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। সেভাবেই মুখে মুখে কবিতা বানিয়ে ফেললেন পদের সঙ্গে পদ মিলিয়ে, তারপর লিখে ফেললেন খাতায়। এবার অক্ষর গুণতেই অবাক, এই তো চোদ্দ অক্ষরের পয়ার আপনা-আপনিই তো তৈরি গেছে! 

তার মানে, ছন্দ তিনি অবচেতনে আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন, চেতনে এবার তা উপলব্ধি করলেন। আর কোন বাধা রইল না। সেই অল্পবয়সেই কবিতার ঘর ও বাহির এভাবে এক হয়ে গেল জসীমের জীবনে।

কবিতার সাধনায় সাধক জসীমের দুই গুরু। কবিগানের গায়কেরা আর শিক্ষক ক্ষীরোদবাবু। তাঁদের কাছে চেতনে-অবচেতনে ভাব আর ছন্দের পাঠ নিয়ে জসীমের স্বভাব সহজ কাব্যভাষাকে বেছে নিয়েছিল। বেছে নিয়েছিল সহজ গ্রাম্যজীবনযাপন আর কবিগানে সহজ ভাষায় গূঢ় বিষয়কে প্রকাশ করার অভ্যেস থেকে।

জসীমের কবিতা আধুনিক জীবন ও প্রকাশভঙ্গির ক্রমবর্ধমান জটিলতার বিপ্রতীপে একটি উদার-আন্তরিক মেঠোপথ। যে-পথের পথিক হতে পারলেই মানুষ পায় অনাবিল শান্তি ও আনন্দ। তাই জসীমের কবিতা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল, প্রকাশমাত্রেই প্রশংসাধন্য হয়েছিল এবং আমাদের চিত্তহরণ করে চলেছে আজও...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...