বেদনায় তিনি অতুলনীয়া

“অনেক ছোটবেলায় জীবন শুরু করেছিলাম। সাফল্যও পেয়েছি সঠিক সময়ে। গ্ল্যামার জগতে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মোটামুটি পনেরো বছর উজ্জ্বল থাকেন, তারপর ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যান। আমি তো তিরিশ বছর ধরে কাজ করে চলেছি প্রথম সারিতে থেকেই। এটাই আমার কাছে সাফল্য। কিন্তু এই সাফল্যের কৃতিত্ব আমার একার নয়। ভাগ্য সাহায্য করেছে। সেই জন্য সহজ হয়েছে পথ চলা”

রূপালী পর্দার দুনিয়ায় নিজের সাফল্যকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলেন নূতন সমর্থ বহেল। চেনা নামে নূতন।

একদিকে মধুবালা। একদিকে নার্গিস। মাঝখানে ওয়াহিদা রহমান। শর্মিলা ঠাকুর। এরকম এক সন্ধিক্ষণে বলিউডে তাঁর ইনিংস শুরু হয়।

 

Nutan1

 

এলোপাথাড়ি ঝোড়ো ব্যাটিং নয়। তিনি এসেছিলেন ক্রিজে টিকে থেকে সেঞ্চুরি হাঁকাতে। এমন স্ট্র্যাটেজির জন্য দরকার সঠিক কোচ।

সেই দিক থেকে বলা যায় নতূন সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছিলেন।

জন্ম মারাঠি পরিবারে। বাবা মা দুজনেই ছবির দুনিয়ায় অত্যন্ত প্রভাবশালী। বাবা মারাঠি ছবি নির্মাতা। কবি হিসেবেও নাম ছিল। মা শোভনা সমর্থ নিজের সময়ে নামকরা অভিনেত্রী।

চার ভাইবোনের মধ্যে নতূন সবচেয়ে বড়। বোন তনুজা সমর্থ পরে অভিনয়কে কেরিয়ার করেছিল। আর এক ভাই জয়দীপ এবং বোন চতুরা।

 

Nutan2

 

ছোট থেকে বড় মেয়ের ওপর ছিল মায়ের কড়া নজর। ফিল্মি পরিবারের জ্যেষ্ঠা কন্যা। তাই প্রত্যাশা খানিক বেশিই ছিল বলা যায়। চোদ্দ বছরের মেয়েকে ছবিতে ডেবিউ করালেন মা। ছবির নাম ‘হামারি বেটি’

ছবি প্রযোজনা করেছিলেন শোভনা সমর্থ নিজেই। কিন্তু সে ছবি তেমন সাফল্যের মুখ দেখল না।

মেয়েকে নায়িকা হিসেবে বলিউডে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও, নতুন নায়িকার আগমন সেভাবে কোনও ঢেউই জাগাতে পারল না আরব সাগরের বুকে।

মেয়ের পারফরম্যান্স থেকে চেহারা সব কিছুকে নিজস্ব আতসকাচের তলায় রাখলেন মা। ভাবনা চিন্তা শুরু করল ন ঠিক কোন জায়গায় বদলটা আনা দরকার।

প্রাথমিকভাবে মেয়েকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন সুইজারল্যান্ড। স্কুলের পাঠ শেষ হয়েছে মুম্বইয়ের সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে। সুইজারল্যান্ডে সিলেবাসের পাঠের পাশাপাশি নূতন ফরাসী ভাষা শিখতেন। একবছর ছিলেন। ওই সময়টাকে সব সময় নিজের জীবনের সেরা সময় বলতেন নূতন।

 

Nutan3

 

জীবনকে সামনে থেকে দেখতে, অনুভব করতে শিখছিলেন। বাড়ি থেকে দূরে বিদেশের একা জীবন তাঁকে যেন স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছিল।

মাঝে মাঝে মাকে ফটোগ্রাফ পাঠাতেন। শোভনা একদিন দেখলেন মেয়ে আসতে আসতে বদলে যাচ্ছে। আগের মতো আর টিংটিঙে রোগা সে সে।

বিদেশের জল হাওয়ায় হয়ে উঠেছে যথেষ্ট নজরকাড়া। শোভনা সমর্থ কয়েকটা ছবি ছবির জগতে তাঁর বন্ধুদেরও দেখিয়েছিলেন। সেই ছবি দেখেই ১৯৫৫-তে নূতনের কাছে এল ‘সীমা’র সুযোগ। চমকে দিল তাঁর অভিনয়! জিতে নিলেন সেরা অভিনেত্রীর সম্মান। ১৯৫৭-র ফিল্মফেয়ার পুরস্কার তাঁর দখলে।

শুরু থেকেই ছকভাঙা পথে চলতে শুরু করেছিলেন নতূন। রোম্যান্টিক ছবির চেনা পথ নয়, চিত্রনাট্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি দেখতেন ছবিতে নায়িকা চরিত্রটির জন্য বরাদ্দ কতটা। ছবির দুনিয়ায় তাঁর পরিচয় তিনি ‘ভার্সেটাইল’। সেই কারণেই তাঁর ছিল নিজস্ব ‘সিরিয়াস অডিয়েন্স’

 

Nutan4

 

তবে চিত্রনাট্য নিয়ে প্রযোজক, পরিচালকদের নাকাল করছেন এমন গল্প কখনও তাঁকে ঘিরে শোনা যায়নি।

ছবির প্রয়োজনে সব কিছু করতে রাজি ক্যামেরার সামনে। যে কোনও ভূমিকায় স্বচ্ছন্দ। তার প্রমাণ দিয়েছেন বারবার। 

সত্তরটিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। পাঁচ-পাঁচবার ফিল্ম ফেয়ার জিতেছিলেন। সীমা, সুজাতা, বন্দিনি, মিলন, ম্যাঁয় তুলসি তেরে অঙ্গন কি’। ‘ম্যাঁয় তুলসি তেরে অঙ্গন কি’ ছবির জন্য ৪২ বছর বয়সে পুরস্কার পান তিনি।

রাগে, দুঃখ বা বেদনায় তিনি অতুলনীয়া। তাঁকে দেখে একটা কথাই আসত ‘সুপার্ব’। চোখের ভাষায় অমন বেদনা ফোটাতে তাঁর মতো আর কেউ পারত না। বিমল রায়ের ‘সুজাতা’ ছবির দলিত কন্যা, ‘বন্দিনী’ ছবির ‘হত্যাকারী’ আজও স্থির হয়ে বসতে দেয় না দর্শকদের। এই অনুভূতিই বারবার সেরা করে তুলেছিল নূতনকে। নিজের সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়েছিলেন। মেলোড্রামার পরিবর্তে রিয়েলিস্টিক অভিনয়ে। নিজে পর্দায় কী দিচ্ছেন সে নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন। তাই বলতেন, “দর্শকরা বোকা নয়...তাঁরা ভালো অভিনয় দেখতে আসেন...”

 

Nutan5

 

টেলিভিশন সিরিজে অভিনয় করেছিলেন। ‘কালীগঞ্জ কি বহু’ দর্শক এবং সমালোচকদের নজর কেড়েছিল।

অভিনয়ের সঙ্গে কোনওদিন কোনও সমঝোতা করেননি। ১৯৫৯-এ ভারতীয় নৌসেনা কমান্ডার রজনীশ বহেলের সঙ্গে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন।

নূতন ভয় পেয়েছিলেন তাঁর পর্দা জীবন হয়ত প্রভাব ফেলতে পারে দাম্পত্যে। তিনি হবু স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁর অভিনয় নিয়ে কোনও আপত্তি আছে কিনা।

উত্তর এসেছিলে, “তুমি পেইন্টার হতে, আমি কি তোমায় তুলি ধরতে বারণ করতে পারতাম! তাহলে অভিনয়ে বাধা কেন আসবে!”

১৯৫৯-এ নূতনের দুটি ছবি মুক্তি পায়। বিমল রায়ের পরিচালনায় ‘সুজাতা’ আর রাজ কাপুরের ‘আনাড়ি’। দুই ছবিই হিট!

রজনীশ বহেল এক নতুন নেশায় ফেলেছিলেন স্ত্রী নূতনকে। নৌ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে বছরের বেশিরভাগ সময়টাই তাঁকে সমুদ্রে থাকতে হত। ভালোবাসতেন প্রকৃতি। জঙ্গল টানত। যখন ফিরতেন তখন পরিবার নিয়ে শিকারে যেতেন। নূতনকে বন্দুক ধরতে শিখিয়েছিলেন তিনিই।

পুত্রের ভাষায়, “ছবির শান্ত স্নিগ্ধ মেয়েটি ব্যক্তিগত জীবনে যথেষ্ট বুনো স্বভাবের ছিলেন।”

ব্যক্তিগত জীবনকে কখনও সামনে আনেননি তিনি। চাইতেন পর্দায় তাঁকে লোকে যত ইচ্ছে দেখুক। কিন্তু ব্যক্তিগত ‘ব্যক্তিগত’ই থাক। আজীবন বজায় রেখেছিলেন সেই ধারা। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...