প্রতিভার বহুমুখে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে হায়েস্ট পেইড চিত্রনাট্যকারই ছিলেন না, ছিলেন সুসাহিত্যিক এবং বেতার জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র।

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল যুগান্তরের যুগে, সেই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের বছর, ১৯০৫ সালে। তখন স্বদেশিয়ানার যে হাওয়ায় সারা বাংলা মেতে উঠেছিল, তাতে নৃপেনের বাবা অতুলও বাদ গেলেন না। মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে সমাজের জন্য কিছু করতে চাইলেন। শিক্ষকতার বৃত্তি নিলেন বঙ্গবাসী স্কুলে। বিলিতিয়ানার ছত্রছায়া থেকে দূরে সরে 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়' মাথায় তুলে নেবার আদর্শকেই বরণ করে নিলেন।

বড় হয়ে ওঠার সময়কালে নৃপেন বাবাকে দেখে বাবার আদর্শকেই নিজের আদর্শ-পথ বলে গ্রহণ করতে লাগলেন। স্বপ্ন দেখতে লাগলেন শিক্ষক হবার, সমাজের জন্য কিছু করার। সেই শিক্ষকতার পাঠ শুরু করে দিলেন ম্যাট্রিক পাশ করার পর নিজের খরচ নিজে চালানোর ব্রত হিসেবে। শুরু করলেন গৃহশিক্ষকতা। ভর্তি হলেন সিটি কলেজে। গৃহশিক্ষকতা ও পড়াশোনার পাশাপাশি বাঙালির ছেলের যেটা জন্মগত বিদ্যে, টুকটাক সেই সাহিত্যের চর্চাও চলতে লাগল।

কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সন্তানদের পড়াতে তাঁর বাড়িতে যেতেন নৃপেন। সেখানেই একদিন আলাপ হয়ে গেল কাজী নজরুলের সঙ্গে। আলাপে বেরিয়ে এল নৃপেনের লেখালেখির প্রতি আসক্তির কথা। নজরুল তখন 'ধূমকেতু' নামে এক বৈপ্লবিক পত্রিকা বের করতে শুরু করেছেন। তার মধ্য দিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন, অধিকার আদায়ের মন্ত্র দিচ্ছেন, যুব সমাজের মধ্যে বিপ্লবের আগুন জ্বালানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। কথায় কথায় বুঝলেন নৃপেনের মধ্যেও সেই আগুন আছে। ব্যস, তাঁর ইচ্ছেয় নৃপেন ধূমকেতু-গোষ্ঠীর একজন হয়ে গেলেন, লিখতে শুরু করে দিলেন 'দিকশূল' ছদ্মনামে।

সিটি কলেজে বিএ পড়তে পড়তে আলাপ হল সহপাঠী শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বন্ধুত্ব হল। 'কল্লোল' পত্রিকা যখন বাংলা সাহিত্যে নতুন বন্দর তৈরি করার উদ্যোগ নিল, তখন বন্ধু শৈলজার সূত্রে নৃপেনও সেখানে এসে ভিড়লেন। শিক্ষকতার স্বপ্নের বিবর্তন ঘটল। শুরু হয়ে গেল তাঁর পরিপূর্ণ সাহিত্য-জীবন। 'দেবব্রত বসু' ছদ্মনামে অনুবাদ করলেন ম্যাক্সিম গোর্কির যুগান্তকারী উপন্যাস 'মা'। অনুবাদটি বাংলা সাহিত্যে বেশ সাড়া ফেলে দিল। উৎসাহিত হয়ে এরপর একে একে অনুবাদ করলেন মূলক রাজ আনন্দের 'কুলী' ও 'দুটি পাতা একটি কুঁড়ি'-র মতো বিতর্কিত ও বহু আলোচিত দুটি উপন্যাস। অনুবাদ সাহিত্যে তিনি নিয়ে এলেন নতুন জোয়ার। শুরু করলেন বিতর্কিত, বৈপ্লবিক এবং মেহনতি মানুষের কথা বলা বিশ্ব সাহিত্যের অনুবাদের কাজ। বিদেশি সাহিত্যকে স্বদেশি ছাঁচে ঢেলে তার ভাবে ও ভাষায় নিয়ে এলেন সুখপাঠ্য-সাবলীলতা। এই সুখপাঠ্য-সাবলীলতাই হয়ে উঠল তাঁর নিজের লেখারও বৈশিষ্ট্য।

এ-সময় শৈলজানন্দ সাহিত্য থেকে বাংলা সিনেমার জগতে পদার্পণ করলেন। 'ছায়া' নামের সিনেমাসংক্রান্ত পত্রিকা প্রকাশ করে শৈলজা হলেন সম্পাদক, নৃপেনকে করলেন তাঁর সহযোগী। এবং এর মধ্য দিয়েই নৃপেনও পা রাখলেন বাংলা সিনেমার জগতে। ১৯৪২ সালে নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত 'মহাকবি কালিদাস' ছায়াছবিতে কালিদাসের ভূমিকায় অভিনয় করে ফেললেন। অভিনয় প্রশংসিত হল। কিন্তু, তার চেয়েও বেশি প্রশংসিত হল এই সময় লেখা তাঁর 'কাশীনাথ' নামের চিত্রনাট্য। বাংলা ছায়াছবির জন্য এটাই তাঁর প্রথম লেখা চিত্রনাট্য।

বাংলা ছায়াছবির কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য তাঁর হাতে পড়ে সাবলীল, সুন্দর, সুষ্ঠু, নির্মেদ, চরিত্রপযোগী এবং যুগোপযোগী হয়ে উঠল। 'রাণী রাসমণি', 'দুই ভাই', 'শেষ পর্যন্ত', 'সাত পাকে বাঁধা', 'ত্রিধারা', 'উত্তর ফাল্গুনী'-র মতো কালজয়ী ছবিগুলো তারই উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর চিত্রনাট্যে নির্মিত 'দাদাঠাকুর' ও 'ভগিনী নিবেদিতা' ছবি দুটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেল।

শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেন। ছোটদের জন্য সম্পাদনা করলেন 'গল্পভারতী' পত্রিকা। তাদের জন্য লিখলেন 'মহিয়সী মহিলা', 'শতাব্দীর সূর্য', 'সেক্সপীয়রের ট্রাজেডী', 'সেক্সপীয়রের কমেডী', 'রাক্ষস খোক্কস'-এর মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থমালা। এছাড়া 'শেলী', 'সুভাষচন্দ্র', 'জওহরলাল', 'জয়দেব' প্রভৃতি বরেণ্য সাহিত্যিক ও দেশনেতার জীবনী রচনার মধ্য দিয়েও সমৃদ্ধ করলেন শিশু সাহিত্যের ভাণ্ডার।

আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ আমৃত্যু। সেখানেও তিনি রাখলেন স্বকীয় এবং উল্লেখযোগ্য অবদান। ছোটদের জন্য 'বিদ্যার্থী মণ্ডল' এবং 'গল্পদাদুর আসর' এই দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা তাঁরই কীর্তি। সদিচ্ছে থাকলে বিনোদনের বেতারকে যে ছোটদের কাছে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলা যায়, এটা তিনি প্রমাণ করে দিলেন। হয়ে উঠলেন ছোটদের সবার প্রিয় 'গল্পদাদু'।

বিচিত্র কর্মময়জীবনে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু, ১৯৬৩ সালে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই প্রতিভাবান মানুষটির মৃত্যু হল। তাঁর মৃত্যুতে 'জনসেবক' পত্রিকা লিখল: ''প্রখ্যাতনামা সাহিত্যকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়...লোকান্তর গমন করিয়াছেন।...কল্লোল যুগের অবিস্মরণীয় সাহিত্যকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় বাংলা জীবনী নূতন রচনা শৈলীর সৃষ্টি করিয়াছেন। অপরূপ বাংলা লিখন ভঙ্গি এখনও পর্যন্ত অননুকরণীয়।"

শোক-সংবাদের শেষের কথাটি কী সিনেমায়, কী সাহিত্যে এখনও অব্দি ধ্রুব সত্যি; তাঁর 'লিখনভঙ্গি' এখনও 'অননুকরণীয়'। তাই তো তিনি কায়িক মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর আজও একান্ত স্মরণীয়...


তথ্যঋণ: 'সোনার দাগ'--গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...