ভারতীয় চিত্রকলায় নতুন রীতির প্রবর্তক চিত্রকর নীরদ মজুমদার

পরিবার তো নয়, যেন ছবিতার দেশ। দাদা কমলকুমার মজুমদার ছবি লিখতেন, ছবি আঁকতেন। ছবি লিখতেন, কেননা এক অননুকরণীয় কাব্যিক ভাষার চিত্রিত রেখায় তিনি সাহিত্য করতেন। বোন শানু লাহিড়ী চিত্রশিল্পী। মধ্যিখানে নীরদ মজুমদার, তিনি ছয় থেকে আটের দশকের বাংলার, শুধু বাংলার কেন ভারতের প্রতিনিধিস্থানীয় আধুনিক প্রতীকী-ধারার বাঙালি চিত্রকর ছিলেন। যে স্বকীয়তা থাকলে বলা যায়, ‘তিনি ছিলেন তাঁরই মত’—সেই স্বকীয়তা তাঁর ছিল। এমনকি বাংলা ভাষায় তিনি যখন স্মৃতিকথা লিখতে বসেছিলেন ‘পুনশ্চ পারী’ নামে, তখন তাঁর লিখনভাষাতেও অননুকরনীয় এক কাব্যিকতায় আমরা তৃপ্ত হয়েছি একদা।

টাকিতে দেশের বাড়ি ছিল। বিদেশের বাড়ি কলকাতার রাসবিহারীতে। ভাড়ার বাড়ি। সেখানেই নীরদের জন্ম হয়েছিল। পিতা প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন পুলিশ অফিসার। কিন্তু পুরো বাড়ি চলত ঠাকুমা যোগমায়া দেবীর দাপটে। সংসারে একটি আধ্যাত্মিকতার পরিমণ্ডলও তিনি রচনা করে রেখেছিলেন। ফলে, নাতিনাতনিরা সেই শৈশবে তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও আধ্যাত্মিকতায় সিক্ত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁদের জীবনে এই প্রভাবের ছায়াছবি যথেষ্ট দেখা যায়।

কমলকুমার আর নীরদ ছিলেন পিঠোপিঠি ভাই। ছিল গলাগলি ভাব। দু’জনেরই একটা নিদারুণ বাউলেপনা ছিল মনে। কারুরই প্রথাগত পড়াশুনো করতে একদম ভালো লাগত না। তবে গতের বাইরে পড়তেন কিন্তু খুব। নিতেন বিশ্বজ্ঞানের পাঠ। সিলেবাসের পড়া কিছুতেই এগোত না। স্কুলেও মন লাগত না। কলকাতায় জন্ম হলেও এক্কেবারে ছেলেবেলার কিছু দিন তাঁর টাকিতে কেটেছিল। ভর্তি হয়েছিলেন নিকটের ‘শিক্ষাসংঘ’ স্কুলে। তাও ভালো লাগেনি। ফলে, পড়ার জন্য ফের কলকাতায় আসতে হয়েছিল। এবার আর বাংলা স্কুল নয়, রীতিমতো ‘ক্যাথিড্রাল মিশনারি স্কুল’-এ। নাহ, সেখানেও মন টেকেনি। তারপর হঠাৎ একদিন শখ হল টোলে পড়ার। কার কাছে যেন কালীঘাটের টোলের সুখ্যাতি শুনলেন। ইচ্ছে এমন চাগাড় দিয়ে উঠল যে, আর ধৈর্য ধরল না। ব্যস, দুই ভাই একদিন একেবারে ন্যাড়া-ট্যাড়া হয়ে রীতিমতো টিকি রেখে একশা অবস্থা করলেন। তারপর সকলকে অবাক করে সেই টোলে ভর্তি হয়ে তারপর বাড়ি ফিরলেন। যথারীতি কিছুদিন পর এই হুজুগেও হুড়কো পড়ল। তবে দুই ভাই কিন্তু সংস্কৃত ভাষাটা শিখে ফেললেন। কিছুদিন এইভাবে চলতে চলতে দুই ভাই ফরাসি ভাষাশিক্ষা শুরু করলেন। সেই সঙ্গে নীরদের আঁকাজোকাও শুরু হল। বয়সে তখনও নিতান্তই বালক। অবন ঠাকুরের আঁকা দেখে তাঁরও সাধ জাগল ছবি আঁকার। অবন তখন ‘বেঙ্গল স্কুল’ ঘরানা তৈরি করে একটা আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন স্বদেশিয়ানার, সেই সঙ্গে বাংলার আধুনিক চিত্ররচনাধারাকেও একটা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।তো, এইভাবেই নীরদের ইচ্ছে হল অবনের মতো করেই ছবি আঁকার। বাড়ি থেকে প্রচণ্ড উৎসাহও পেলেন। মাত্র তের বছর বয়সে ভর্তি হয়ে গেলেন ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’-এ। এখানে এসে তাঁর একটা স্বপ্নপূরণ হল। সরাসরি স্বপ্নের চিত্রকর অবনীন্দ্রনাথকে শিক্ষক হিসেবে না-পেলেও, পেলেন অবনীন্দ্রনাথের সুযোগ্য ছাত্র ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ মজুমদারকে। তাঁর সাহচর্যে বেশ মন বসে গেল ক্লাসে। চিত্রচর্চা হয়ে উঠল ক্রমে অন্তরের ধন। এবং অচিরেই ছবি আঁকায় কৃতিত্ব দেখিয়ে ওখান থেকে ‘নরম্যান ব্লান্ট স্মৃতি পদক’ পুরস্কার অর্জন করে সবাইকে একেবারে অবাক করে দিলেন।

যত দিন যেতে লাগল, মন ততই অন্যের পথ ছাড়িয়ে স্বকীয়তার পথে হাঁটতে চাইল, অন্য কিছু করে দেখাতে চাইল। এই উচাটনের মধ্যেই তিনি একদিন যৌবনে আরোহণ করলেন। ঠিক এই সময়ই দেশের বুকে একদিকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই চলছে, অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ক্রমে কলকাতার বুকে ব্ল্যাক আউট, কালবাজারি শুরু হল, মন্বন্তরপীড়িত গ্রামের মানুষ ফ্যানের আশায় ভিড় করল শহরের রাস্তায়, অসহায়ভাবে নিরন্নশরীরে মরতে লাগল দলে দলে। মানবতার এই অবক্ষয়কে দেখে বিচলিত হলেন, খুঁজতে লাগলেন ক্ষোভ-রাগ ও প্রতিবাদকে পুঞ্জীভূত করে প্রকাশের ভাষা।  বিশ্বসচেতন নীরদ শুনলেন বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে বিশ্বের তাবড় তাবড় শিল্পীরা ছবি এঁকে প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু তিনি বুঝলেন যে, প্রচলিত চিত্রভাষায় নব্যবঙ্গধারার কোমল ও সহজ রেখায় এই প্রতিবাদ বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ করা যাবে না। নতুন ভাষা নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করতে হবে। এখান থেকেই সমধর্মী সমমনস্ক চিত্রশিল্পীদের নিয়ে ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করলেন। চলল সমবেতভাবে অভিনবত্ব আনয়নের প্রয়াস। এই প্রয়াস করতে করতেই তিনি অনুভব করলেন যে, কিছু করতে হলে বিদেশে গিয়ে একেবারে হালের ধারাটি অর্জন করে আসতে হবে, নইলে হবে না।

বিদেশ বলতে, প্যারিস। কেননা, সেই সময় প্যারিস ছিল সমগ্র বিশ্বের শিল্প-সংস্কৃতির তীর্থভূমি। নীরদের কপাল খুলল, সরকারি বৃত্তি নিয়ে বছর তিনেকের মধ্যেই সুযোগ মিলল সেখানে যাবার। সেখানে গিয়ে দেখলেন, বিশ্বের প্রতিভাবান শিল্পীরা তথায় একেবারে আড্ডা জমিয়ে দিয়েছেন। সেখানকার চিত্রশিক্ষা কেন্দ্রে তাঁরা চিত্রবিদ্যা শিখছেন, লাইব্রেরীতে বিশ্বের শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে পড়াশুনো করছেন, ল্যুভর মিউজিয়ামে প্রদর্শনী দেখছেন, ক্যাফেতে সমধর্মীদের আড্ডায় উপলব্ধি উজাড় করে দিচ্ছেন। বাহ, বেশ তো! অল্পদিনে অবশ্য নীরদ এঁদেরই একজন হয়ে উঠলেন। বিদেশিদের মধ্যে, তিনি আগেই সেজানের চিত্ররীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এবার একেবারে হালের স্বনামধন্য চিত্রকর পিকাসো, বার্ক, বাঁকুশি প্রভৃতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। অন্তরঙ্গতা তৈরি হল। তাঁদের কাছ থেকে ক্রমে নিজেকে সমৃদ্ধ করলেন।

Painting-of-Nirode-Majumder

শুধু চিত্রকলার প্রদর্শনীতেই এই সময় নিজেকে সীমাবদ্ধ করলেন না নীরদ—প্যারিসের হালফিলের সাহিত্য, কাব্য পড়তে লাগলেন; নিয়মিত দেখতে লাগলেন অপেরা-থিয়েটার। ফরাসিদের মধ্যে আপন সংস্কৃতি ও শিল্পের চর্চা দেখে এসবের মাঝেই তিনি উপলব্ধি করলেন, এখান থেকে যে শিক্ষা তিনি নিলেন, দেশে গিয়ে তার জলছাপ তৈরি করলে চলবে না। এই শিক্ষাকে ভারতীয় শিকড়ের সঙ্গে সংশ্লেষিত করে তৃতীয় কিছু তৈরি করতে হবে, নিজস্ব পথ তৈরি করতে হবে। নইলে সমস্তই ব্যর্থ। ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠার পর ঠাকুমার শেখানো আধ্যাত্মিকতার পথ বেয়ে তিনি ভারতীয় তন্ত্র সম্পর্কে বেশ পড়াশুনো করেছিলেন। তন্ত্রের বিভিন্ন জ্যামিতিক প্যাটার্ন ও তান্ত্রিক সিম্বলকে আত্মস্থ করেছিলেন; এবার  ফরাসি চিত্ররীতির হালের সিম্বলিজম এবং আভাগার্দ চিত্ররীতির সঙ্গে তাকে সংশ্লেষ করে নিজস্ব উপলব্ধিতে জারিত করে ছবি আঁকা শুরু করলেন।

ভারতীয় ও ফরাসি চিত্ররীতির মেলবন্ধনে নীরদ ক্যানভাসে তুলে ধরলেন জীবনের দ্বান্দ্বিক সংকটগুলোকে। ইমেজকে সংহত জ্যামিতিক বিন্যাসের মাঝে এক অনির্বচনীয় বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও অভিনব কাব্যময়তা দিলেন। তার ফলে তিনি যখন ভারতীয় পুরাণের চেনা ঘটনার ছবি আঁকতে বসলেন, চেনা চরিত্রকে চিত্রিত করতে বসলেন, তখন তারা পূর্বসূরিদের তুলির টানের মতো পেলব হল না; অভিনব এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অবনীন্দ্রনাথের ঘরানার পেলবতার বিপ্রতীপে সেই বলিষ্ঠ, আত্মপ্রত্যয়ী অভিব্যক্তিই হয়ে উঠল তাঁর চিত্ররীতির বৈশিষ্ট্য। তাতে ধরা রইল ব্যঞ্জনাময়তার চূড়ান্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের যুগলবন্দি কাব্যগন্থ ‘সুন্দর রহস্যময়’-এ তাঁর অলঙ্করণে সেই ব্যঞ্জনাময়তার অসাধারণ এক প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়।

গুরু অবনীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে তাঁকে অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে এই যে নতুন পথ নীরদ তৈরি করেছিলেন, তাই-ই হয়ে উঠেছিল ছয়ের দশকে ভারতীয় চিত্ররীতির নবতম ধারা। নিতুই-নব সৃজনের পথ বেয়ে যে ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে আজও। ভারতীয় চিত্রকলায় ভগীরথ হয়ে পুরাতন ও নবীনের সংশ্লেষে এই ধারামুক্তির জন্য তিনি হয়ে রয়েছেন চিরস্মরণীয়। আর রয়েছে তাঁর চিত্রমালা, যা এখনও প্রসারিত করে চলেছে নতুন নতুন ব্যঞ্জনার আকাশ…

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...