আটের দশকে যখন রব উঠেছিল, ‘এত কবি কেন?’, নতুন কবিদের পদধ্বনি যখন প্রতিষ্ঠিত অনেক কবিরই পছন্দ হচ্ছিল না, তার বহু আগেই বাংলা কাব্যসাহিত্যে ভগীরথের মতো নতুনদের আহ্বান জানিয়েছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। জীবনানন্দের ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ আপ্তবাক্যে তাঁর আস্থা ছিল না, তিনি লিখেছিলেন ‘কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি’। আপামর সবাইকে পদ্যের প্রাঙ্গণে হাজির করতে তিনি একদা লিখেছিলেন, ‘বিশ্বাস করুন চাই না-করুন, কবিতা লেখা সত্যিই এমন-কিছু কঠিন কাণ্ড নয়। সে তুলনায় পদ্য লেখা আরও সহজ।’ আর তাই 'আনন্দবাজার পত্রিকা'র পাতায় 'কবিকঙ্কণ' ছদ্মনামে তিনি খুলে ফেলেছিলেন ‘কবিতার ক্লাস’। সেই ক্লাসে হাজির হয়েছিলেন কবি হতে আগ্রহী ও কবিতার রস পেতে আগ্রহীরা। এমনকি কবি শঙ্খ ঘোষ, প্রাবন্ধিক ভবতোষ দত্ত, ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেনও বাদ যাননি। সেখানে শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে প্রাত্যহিক দৈনন্দিনজীবনের গদ্যময় হতচ্ছেদার শব্দমালাও যে পদ্যময় হয়ে উঠতে পারে, অত্যন্ত সরসভঙ্গিতে সেটা দেখিয়ে দিতে দিতে তিনি আমাদের কখন ডুবিয়ে দিয়েছিলেন ছন্দের মায়ায়; শিখিয়ে দিয়েছিলেন ছন্দের ঘর ও বাহির, আমরা বুঝতেই পারিনি। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আইন না-জানলে কখনই আইন ভাঙার আনন্দ পাওয়া যায় না।
কবিতার বারান্দায় তিনি নিজে ঠাঁই নিয়েছিলেন নিতান্ত বাল্যকালেই। সেই বয়সেও তাঁর প্রথম কবিতা লেখা যেন অনেকটা কবি রামপ্রসাদের হিসেবের খাতায় শ্যামা মায়ের গান লেখার মতো করেই শুরু হয়েছিল। তখন বছর দশেক বয়স তাঁর। শেলেটে অঙ্ক কষতে দিয়েছিলেন জ্যাঠতুতো দাদা। কিন্তু, তিনি অঙ্ক কষবেন কী, মনটা থেকে থেকেই উচাটন হয়ে উঠছে! কারণ, খানিক আগেই রান্নাঘরে গিয়েছিলেন; আর তখনই মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখে এসেছেন জম্পেশ কিছু কই মাছ। তার মানে, দুপুরের খাওয়াটা বেশ জুতসই হবে! মনে তাই থেকে থেকেই ঘনিয়ে উঠছে বেশ রসেবশের আনন্দ। অঙ্কের গা গাবিয়ে সেই আনন্দই অনুপ্রাস নিয়ে উঠে এল শেলেটে, হয়ে উঠল তাঁর কবিজীবনের আদি পদ্য—
‘আজ বড় আনন্দ হইয়াছে।
দেখিয়াছি রান্নাঘরে কই আছে।’
সুতরাং, সাধারণ মুখের কথাকে কবিতার ছাঁচে ফেলেই কবিতার রাজ্যে তাঁর পদার্পণ। ফলে, সাধারণের মুখের ভাষাই হয়ে উঠল তাঁর কাব্যভাষা, সেখানে তাঁর প্রতিভার স্পর্শে কালে কালে গদ্যের পদপংক্তি আশ্চর্যরকমভাবে বাঁক নিল পদ্যের বিস্তারে, দর্শনের ছোঁয়া নিয়ে তা হয়ে উঠল মানিকমালা। এই দর্শন থেকেই তিনি একদিন আবিষ্কার করলেন গৃহহীন ফুটপাথবাসী কালো আদুড় গায়ের শিশুর মধ্যে ঈশ্বরের দূত যীশুকে। যার মধ্যে রয়েছে ভোগবাদের পিছনে ছুটে চলা উদ্ধতগতিকে স্তব্ধ করে দেবার অদম্য ক্ষমতা। শিশুটি যেন যান্ত্রিকতার মাঝে মানবতার মূর্ত প্রতীক—
‘দু-দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও।
যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে
সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেতে চাও
হাতের মুঠোয়। যেন তাই
টালমাটাল পায়ে তুমি পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য-কিনারে চলেছ।’
(‘কলকাতার যীশু’ কবিতা)
নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় ইতিহাস-ভূগোল-মানুষের পরিধি বিস্তৃত হতে হতে বিশ্বের পরিধি ছুঁয়ে যায়। আদুড় শিশু থেকে যিশু, মানবতার প্রতীক হয়ে সারা বিশ্বের গৃহহীন সংগ্রামী মানুষের কথা বলে যায়, যারা অন্যের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে বঞ্চনার ক্রুশে বিদ্ধ হতে হতে মানুষের শুভবুদ্ধি জেগে ওঠার অপেক্ষায় বেঁচে থাকে, পুনর্জীবিত হয়। তাঁর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতাতেও শিশু জাগ্রত মানবতার প্রতীক। যে ভোগবাদের ভয়-লালসাকে উপেক্ষা করে পবিত্র উচ্চারণে বলতে পারে, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ নীরেন্দ্রনাথের কবিমানসীতে এই শিশুটির উপস্থিতি শুধু মানবতা, নির্ভীক উচ্চারণে পাই তা নয়, ‘রূপ-কাহিনী’ নামের দীর্ঘকাব্যের পংক্তিমালায় ফরিদপুরী স্মৃতি-সত্তাকে হারিয়ে না-ফেলেও নগর কলকাতার একজন হয়ে ওঠার বাসনায় পাই। অমলকান্তির রোদ্দুর হবার স্বপ্নে পাই। ‘কবি চেনে, সম্পূর্ণ চেনে না’—এমন সরল অথচ সবল স্বীকারোক্তিতেও পাই। স্বপ্নময় এক নতুন দিনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে যে নিষ্পাপ ও সংগ্রামী শিশুটি, সে চিরকাল বসন্তের নরম রোদ্দুরের সাথে খেলা করেছে নীরেন্দ্রনাথের কবিমানসীর অন্তরে। তাঁর কবিতায়। সেই শিশুটির হাতে তিনি আমাদের হাত ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন আজীবন।
পদ্যের আঙিনায় নীরেন্দ্রনাথের যেমন স্বতন্ত্র উচ্চারণের দিগন্ত-বিধৌত জ্যোৎস্না, তেমনি গদ্যের ফেরিঘাটেও তিনি গড়ে নিয়েছিলেন নিজস্বতার সেতু। শব্দের অমোঘ ব্যবহার ও রসিকতার রসে তাঁর গদ্য অত্যন্ত স্বাদু ও সুখপাঠ্য। ‘মুকুন্দপুরের মনসা’-র মতো রহস্য উপন্যাসমালায় তাঁর সৃষ্ট অনবদ্য চরিত্র ‘ভাদুড়িমশাই’ বুদ্ধি-পাণ্ডিত্য-রসিকতা ও রহস্যময়তায় পাঠকের মুগ্ধতা সহজেই আদায় করে নেন। জন্মস্থান ফরিদপুর থেকে কর্মস্থান কলকাতা অব্দি নিজের জীবনপ্রবাহকে নীরেন্দ্রনাথ সেই স্বাদু গদ্যের ধারায় দর্শনের বিন্দু থেকে সিন্ধুর দিকে পৌঁছে দিয়েছেন আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘নীরবিন্দু’-তে। আসলে, নীরেন্দ্রনাথ এমন একজন সাহিত্যিক, যিনি তাঁর কবিতায় বা গদ্যে সর্বত্রই এক নির্মোহ আশাবাদের দাগ রেখে যান, তাঁর কাছে হারিয়ে গিয়েও কিছুই যেন হারায় না। সবকিছুরই দাগ থেকে যায়। সেই আশার আলো ছড়াতে ছড়াতেই তাঁর সৃষ্টির সিন্ধু নিয়ে নীরেন্দ্রনাথ সাধারণের হয়ে উঠেছেন বহুকাল, তাদের হৃদয়ের উত্তাপ থেকে তিনি কখনই হারিয়ে যাবেন না। সেটা তিনিও সবিনয়ে উপলব্ধি করেছিলেন—
‘কখন যে একদল মানুষ আমাকে ঘিরে ফেলেছে,
তা আমি বুঝতে পারিনি।
হাত ধরে যিনি আমাকে এই হাটের মধ্যে এনে
ছেড়ে দিয়েছিলেন, চোখের পলক ফেলতে না-ফেলতেই তিনি
জাদুকরের পায়রার মতো
ভ্যানিশ।
বুঝতে পারছিলুম যে, আমারও এখন
সরে পড়া দরকার। কিন্তু
মানুষের বলয়ের বাইরে যেই আমি আমার
পা বাড়িয়েছি অমনি
কেউ একজন বলে উঠল, ‘যাবেন না’।
(‘যাবেন না’-কবিতা)