বাংলা সাহিত্যে নারায়ণ সান্যালের মতো এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে আর কেউ গ্রন্থ রচনা করতে পারেননি। বাংলা সাহিত্যে বেস্টসেলার লেখক যে ক’জন আছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বইপাড়ায় যে-কোন বইয়ের দোকানে গেলেই তাঁর ‘বিশ্বাসঘাতক’ বইটি কেউ-না-কেউ কিনছেন, এটা হামেশাই চোখে পড়ে। লেখালেখির জন্য পুরস্কার তিনি পেয়েছেন অনেক, কিন্তু সর্বভারতীয় সাহিত্য পুরস্কার পাননি। অথচ তাঁর শক্তিমান কলম বাদ দিয়ে সেই বিশেষ পুরস্কারটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে কোথাও কোথাও কারও কারও কাছে। কেননা, বাঙালি যেখানেই থাকুক না কেন, বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়া সে যেন আলাদা করে লেখককে গ্রহণ করতে পারে না। তেমনই একটি ঘটনার কথা তাঁর কৌতুকময় কলমে উঠে এসেছে ‘ষাট একষট্টি’ নামের আত্মজৈবনিক গ্রন্থেঃ
‘লস এঞ্জেলস-এর দুর্গাপূজা মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে গেছি।…পূজা-মণ্ডপে নাচ-গান ভ্যারাইটি প্রোগ্রাম। বাচ্চারা ‘আলিবাবা’ অভিনয় করবে। উদ্যোক্তারা বললেন, এসেই যখন পড়েছেন তখন মঞ্চে উঠে দু-চার কথা বলুন।…কর্মকর্তাদের কেউ হবেন—আমাকে দর্শকদলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব নিলেন।…মঞ্চে অবতীর্ণ হবার আগে ভদ্রলোক জনান্তিকে আত্মীয় সম্বোধন করে বললেন, মেসোমশাই, আমি ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ার, বাংলা বই-টই, মানে বিশেষ পড়ি-টড়িনি; —ইয়ে হয়েছে, আপনি যদি আপনার লেখা খানকতক বইয়ের নাম বলে দেন…
আমি বলি, কী দরকার? তুমি শুধু বলো, ইনি বই-টই লেখেন—
—না মানে, অন্তত আপনার একাদেমী পুরস্কার পাওয়া বইটার নাম যদি…
আবার বাধা দিয়ে বলি, তুমি ভুল করছ ভাই। একাদেমী পুরস্কার আমি আদৌ পাইনি। তুমি আমার ওপর যা-ইচ্ছে গুণের আরোপ করতে পার; শুধু বোলো না—আমি ভালো গান গাই বা ভালো রাঁধতে জানি। কারণ এ পূজা-মণ্ডপে তা যাচাই হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে।’
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দিলাম মূলত তিনটে কারণে। যথাঃ
এক, উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট বাঙালির মানসিকতা একশ বছরেও পরিবর্তিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার আগে এক শ্রেণির পাঠক, যাঁরা উন্নাসিক ছিলেন তাঁর সম্পর্কে, তাঁরাই হামলে পড়েছিলেন পুরস্কার পাওয়ার পর। এখনও এই ধরণের বাঙালি লেখকের লেখনক্ষমতা অর্জিত পুরস্কার দিয়ে বিচার করেন। হামেশাই নিজে বিড়ম্বনায় পড়েন এবং লেখককেও বিড়ম্বনায় ফেলেন।
দুই, লেখক হিসেবে নারায়ণ সান্যালের কৌতুকপ্রিয়তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত এই অংশটি। সহৃদয় রসিক লেখক তিনিই, যিনি নিজেকে নিয়েও কৌতুক করতে পারেন এবং নির্মল এক বিভা ছড়িয়ে দিতে পারেন। স্যাটায়ার করতে পারেন, কিন্তু নিজেকে বিদ্ধ করে অন্যকে ঋদ্ধ করতে পারেন। এই সাহিত্যগুণ এই প্রসাদগুণ নারায়ণ সান্যালের লেখনির মধ্যে বহাল তবিয়তেই দেখা যায়।
তিন, প্রবাসী বাঙালিটি নিজেকে ‘ইলেক্ট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ার’ পরিচয় দিয়ে ‘বাংলা বই-টই’ তাচ্ছিল্যে যে বক্তব্যটি রেখেছেন, তাতে অনুশোচনা নেই, বরং আত্মপ্রসাদ রয়েছে। এঁরাই কিনা প্রবাসে বঙ্গসংস্কৃতি রক্ষা করছেন! অথচ নারায়ণ নিজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়েও সুরসিক সাহিত্যিক হতে কোথাও আটকায়নি। বরং বাংলা সাহিত্যকে বিবিধ বিষয়ে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি দীর্ঘ সময় ধরে।
হ্যাঁ, বিষয়ের বিবিধতা নারায়ণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জাপানি কাগজ ভাঁজের খেলা, কাগজ ভাঁজ করে ত্রিমাত্রিক ফুল, পাখি, পুতুল তৈরির ওপর বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম বই লেখেন ছোট ও বড়দের জন্য। কাগজ ভাঁজের এই খেলাকে জাপানি ভাষায় বলে ‘অরিগামি’। তাঁর বইয়ের নামও তাই। ইঙ্গিনিয়ারিং-এর বিষয়কে রসরচনার আধার দিয়ে তিনি যেমন লিখছেন ‘বাস্তশাস্ত্র’; তেমনি বাস্তবিদ্যা, প্রত্নতত্ত্ব ও সৌন্দর্যরসিকের দৃষ্টিকে মিলিয়ে দিয়েছেন ‘রূপমঞ্জরী’ বা ‘অজন্তা অপরূপা’র মতো গ্রন্থাবলীতে। ইতিহাসের লিপি থেকে জীবন্ত করে তুলেছেন সুতনুকাকে। লিখেছেন, ‘সুতনুকা একটি দেবদাসীর নাম’। চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যের বহুধা বিষয় তাঁর সমৃদ্ধ লেখনিতে কাহিনি হয়ে উঠেছে, তারই একটি উদাহরণ ‘রোঁদ্যা’। বাংলায় প্রথম তিনিই ভাষায় বেঁধেছেন ‘দান্তে ও বিয়াত্রিচে’র প্রেম। বাঙালির রহস্য রোমাঞ্চের প্রীতিকে মাথায় রেখে রচনা করেছেন ‘কাঁটায় কাঁটায়’ সিরিজ। বিজ্ঞানকে বেঁধেছেন উপন্যাস ও না- উপন্যাসের আধারে। লিখেছেন, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা’। রচনা করেছেন সাম্প্রতিক অতীত ছোঁয়া বিতর্কিত বিষয়ে গবেষণাধর্মী বই, ‘আমি নেতাজিকে দেখেছি’।
আসলে এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে অবাধ যাতায়াতও নারায়ণের আর-এক বৈশিষ্ট্য। অগাধ অধ্যবসায় ছিল তাঁর। আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতাও ছিল এক বই থেকে অন্য বইয়ে বিষয় পরিবর্তনের। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটাই কুমিরছানা দেখার অভিজ্ঞতা পাঠকের হয় না তাঁর রচনা পড়তে গিয়ে। তাঁর রচনায় অসাধারণ পাঠপরিধি ও বাস্তব অভিজ্ঞতার এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন দেখা যায়। তাই উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে তিনি উপন্যাস লিখতে বসে খবরের কাগজের রিপোর্টকেই সম্বল করেননি। ‘দণ্ডকশবরী’ বা ‘বকুলতলা পি এল ক্যাম্প’ লেখার আগে তিনি দণ্ডকারণ্যে গিয়ে শরণার্থীদের সঙ্গে বহুকাল থেকেছেন, আন্তরিকভাবে তাঁদের সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলো অনুধাবন করেছেন, তাঁদের একজন হয়েছেন; তারপর তাকে সাহিত্যের পাতায় ভাষারূপ দিয়েছেন।
আসলে, এই যে বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠা, তথ্যের প্রতি আগ্রহ এ-দুইই তিনি অর্জন করেছিলেন বিজ্ঞানের কাছ থেকে। ছাত্রাবস্থায়। যার পরিণতি ঘটেছিল শিবপুর বি ই কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে। আর তাতে সাহিত্যিকের সরসতা উপ্ত হয়েছিল জন্মসূত্রে। কেননা, তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা যে রসিক-নাগরের দেশে; নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। জন্ম ১৯২৪ সালের ২৬ এপ্রিল। মা, বসন্তলতা; পিতা, চিত্তসুখ সান্যাল। তাঁর পিতৃদত্ত নাম যদিও ‘নারায়ণদাস সান্যাল’; কিন্তু লিখতে এসে ‘দাস’কে বিদায় জানিয়ে হয়ে উঠেছিলেন নির্মেদ নির্ভেজাল ‘নারায়ণ সান্যাল’।
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন বলেই বোধ হয় আপন রচনায় ফর্মের ব্যাপক ভাঙচুর করে তাকে বারে বারে অন্য রূপে গড়তে চাইতেন নারায়ণ সান্যাল। কারণ, তাঁর প্রতিটি রচনাই উপন্যাস না-উপন্যাস, গল্প না-গল্প, বিজ্ঞান না-বিজ্ঞান, থ্রিলার না-থ্রিলার, গোয়েন্দা কাহিনি না-গোয়েন্দা কাহিনির গোলকধাঁধায় ঘোরে। আর তাতে পাঠককে ঘুরিয়ে তিনি অভূতপূর্ব এক রসের সন্ধান দেন দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সাহিত্যজীবনে নারায়ণ সান্যালের গল্প-উপন্যাস ছায়াছবি হয়ে ওঠার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবে তাদের মধ্যে ‘সত্যকাম’, ‘যদি জানতেম’, ‘নীলিমায় নীল’, ‘অশ্লীলতার দায়ে’, ‘নাগচম্পা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই ছবিগুলোও সমকাল পেরিয়ে কালের দরবারে রয়ে গেছে, তাঁর সাহিত্যের মতোই।
আসলে, বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় নারায়ণ সান্যালের একটি বিশেষ স্থান আছে। তিনিই নির্মাণ করেছেন। শিল্পসাহিত্যের বহুধা বিষয়কে তিনি যেভাবে আত্মস্থ করে বাংলা সাহিত্যের গঙ্গাধারায় বইয়ে দিয়েছেন, তেমনটি তাঁর আগে বা পরে আর কেউ পারেননি। শুধু বিষয় বৈচিত্র্য নয়, তাকে পাঠকের অন্তরের ধন করে তোলা সহজ কাজ নয়, সেই কাজটিও নারায়ণ সান্যাল করেছেন অত্যন্ত মুন্সীয়ানার সঙ্গে। তাই মহাকালের দরবারে তাঁর সাহিত্য তাঁর রচনা কালের করাল গ্রাস উপেক্ষা করে থেকে যাবে আরও বহু বহু যুগ…