"পুরো ছ'হাত লম্বা, গণ্ডারের খাঁড়ার মতো খাড়া নাক, খটখটে জোয়ান। গড়ের মাঠে গোরা ঠেঙিয়ে স্বনামধন্য। হাত তুললেই মনে হবে রদ্দা মারল, দাঁত বার করলেই বোধ হবে কামড়ে দিলে বোধ হয়।"
বর্ণনা পড়লেই পাঠক বুঝে যায় কার কথা বলা হচ্ছে। মধ্য কলকাতার ২০ নম্বর পটলডাঙা স্ট্রিটের এই বাসিন্দাকে তারা চেনে টেনিদা নামে। পোশাকি নাম ‘ভজহরি মুখার্জী'।
আর বইয়ের পাতার টেনিদার আড়ালে যে ব্যক্তিটি লুকিয়ে আছেন তাঁকে নিয়ে আজও কৌতূহলের শেষ নেই পাঠকদের।
কাগজে কলমে চেহারা খানা বদলে দিলেও পাড়ার ডাকনামখানা বদলাননি টেনিদার লেখক।
টেনিদার আসল নাম প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়। বাড়িও ২০ নম্বর পটল ডাঙা স্ট্রিটেই।
টেনিদার সঙ্গে লেখকের ছিল বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে সম্পর্ক। কিন্তু সে সম্পর্ক বেশ মধুর।তাই বিকেল হলেই বাড়ির সঙ্গের রকটা জমে উঠত কথা আর আড্ডায়।
সেই সব ছড়ানো ছেটানো কথা আর চিরকেলে বাঙালি আড্ডার নির্যাস টুকুই কলমের গুণে ধরা দিয়েছিল বাংলা কিশোর সাহিত্যের অন্যতম সেরা সংকলনের দুই মলাটের অন্দরে।
ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন ‘টিএনজি’। পিতৃ প্রদত্ত নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
আর বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে তিনি ‘নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়’।
প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সেই বিরল সাহিত্যিকদের একজন যাঁদের সাহিত্য সৃষ্টিকে ভাগ ভাগ করে খোপে লেবেল এঁটে দেওয়া যায় না। এদের বুঝতে হয় সৃষ্টির সমগ্রতায়।...’
তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। সাহিত্যের অঙ্গনে যখন পা রাখলেন তখন দেশ সব স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু চারপাশের অস্থিরতা বেড়েছে বৈ কমেনি। সময়টা পঞ্চাশের দশক।
পারিবারিক আবহাওয়া পুষ্ট করেছিল তাঁর রাজনীতির বোধকে। মেজদাদা শেখরনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সশস্ত্র বিপ্লবে অংশ নিয়ে কারাবন্দী হন। বাবা প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পুলিশ কর্তা। সরকারী চাকরি ছেড়েছিলেন ইংরেজ সরকারের গোলামি করবেন না বলে। তারকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে নারায়ণ নিজে বিশ্বাস করতেন গান্ধীবাদী দর্শনে। যদিও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এক বছর অন্তরীন থাকতে হয়েছিল। ছেদ পড়েছিল পড়াশোনা। আই. এ পরীক্ষা দিতে পারেননি।
অস্থির সময়ের প্রতি রাগ, ক্ষোভ উগরে দেওয়ার জন্য অস্ত্র করেছিলেন শানানো কলমকে।
বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দেশভাগের তোলপাড় ওলোটপালোট করে দিয়েছিল একটা গোটা দেশ আর জাতিকে। উত্তাল বঙ্গ ধরা পড়ল তাঁর সাহিত্যে।
জন্মেছিলেন পূর্ববঙ্গে। বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গে। স্থায়ীবাস কলকাতায়।
১৯১৮ সালে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী অবিভক্ত বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার বালিয়াডিঙ্গি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
ছোটবেলায় ডাকনাম ছিল ‘নার’। বাবা-মায়ের অষ্টম সন্তান।
বাবার পেশার কারনেই পরবর্তী সময়ে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন উত্তরবঙ্গে।
নিজের শিকড়, অতীত, ফেলে আসা ‘দেখা’ তাঁর লেখায় প্রভাব ফেলেছিল। নিজের চোখে যে জীবনকে দেখেছিলেন সেই জীবন তার নিজস্ব মাটির রূপ, রঙ, গন্ধ নিয়ে ধরা দিয়েছিল।
তাই সেখানে ডুয়ার্সের জঙ্গলের আদিমতা যেমন আছে তেমনি আছে বরেন্দ্রভূমির সৌন্দর্য।
প্রথম লেখা ছাপা হয় মাস পয়লা শিশু মাসিকে। সন্দেশ, মুকুল, পাঠশালা, শুকতারা প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখেছেন।
পরবর্তী সময়ে ছোটগল্প, উপন্যাস থেকে শুরু করে সাহিত্যের সমস্ত ক্ষেত্রে নিজের স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
তাঁর ছোটগল্প পড়ার পর স্তব্ধ করে রাখতে পারে পাঠককে। বিষয় এবং ভাষা এতটাই শক্তিশালী যে পাঠ করার পর হাজার কাজের ভিড়েও পাঠের অনুভূতি ফিকে হয়ে যায় না, বরং দগদগ করতে থাকে। কখনও বা স্থায়ী প্রদাহ রেখে যায়। আবার টেনে আনে তাঁর লেখার পাশে।
ছোটগল্পকার হিসেবে পেয়েছিলেন ডি.লিট সম্মান।
তবে শুধু মাত্র সাহিত্যিক হিসেবে নন, অধ্যাপক হিসেবেও তিনি প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব।
বিশ্ব বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেই অধ্যাপক জীবনে প্রবেশ। ১৯৪২ সালে জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজে যোগদান করেন।পরবর্তী সময়ে সিটি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন।
ছাত্রছাত্রীদের কাছে এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তাঁর ক্লাস নেওয়ার গল্প মিথ হয়ে গিয়েছিল পরবর্তী সময়ে।
শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ তাঁর ছাত্র।
টিএনজি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, তাঁর ছাত্রজীবনের একটি অভিনয় দেখে শিক্ষক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন , ‘দেখবে, তুমি একদিন অনেক বড়ো অভিনেতা হবে, অনেক বড় , আর তখন আমি বসে বসে তোমার জীবনী লিখব৷’
চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন। তাঁর রচিত বহু গান চলচ্চিত্রে ও রেকর্ডে গৃহীত হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে তিনি সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ‘সুনন্দ’ ছদ্মনামে লিখতেন 'সুনন্দর জার্নাল'। বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতির যাপন নিয়মিত উঠে আসত তাঁর কলমে। পাঠকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
কলম লিখতে লিখতেই যেন আঁচ করতে পারছিলেন কলমের কালি যেন ফুরোবার দিকে। জার্নালের এক সংখ্যায় লিখেছিলেন, ‘ সুনন্দর পাতাটি যদি না থাকে তাহলে জানবেন আর একটি কমনম্যান বাঙালীর অবলুপ্তি বা আত্ম বিসর্জন ঘটল।’
পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় সত্যি সত্যিই কলম থমকে যায় সুনন্দর। পরের সংখ্যাতে আর তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯৭০ সালের ৬ নভেম্বর সেরিব্রাল অ্যাটাকে মৃত্যু হয় কলকাতায়।বয়স তখন মাত্র ৫২৷
৫২ বসন্তের আয়ুষ্কালে ৩২ টি বসন্ত কেটেছিল কেবল কলম যাপনে।