মতিলাল শীল সেই মানুষ, যিনি স্বনির্ভরতার চূড়ান্ত উদাহরণ। শূন্য থেকে সম্পূর্ণ নিজের বুদ্ধি, সততা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, কীভাবে দশজনের একজন হওয়া যায়, সেই শিক্ষা তাঁর জীবন থেকে পাওয়া যায়। শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, ধর্মে, জনসেবায় অর্জিত সম্পদ অকাতরদানে তিনি সমকালে উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন; এখনও উদাহরণ হয়ে রয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন একজন প্রবল সমাজ সংস্কারক। ইংরেজ-শাসনে ইংরেজের সম্ভ্রম আদায় করে বাঙালির গৌরব হয়ে ওঠা এক প্রবল ব্যক্তিত্ব।
মতিলাল কলকাতার কলুটোলায় মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম সন নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর জন্মসন ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ লিখেছেন; আবার ‘সুবর্ণবণিক-কথা ও কীর্তি’ গ্রন্থে নরেন্দ্রনাথ লাহা তাঁর জন্মসন লিখেছেন ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দ। মতিলালের পিতা চৈতন্যচরণ ছিলেন চিনাবাজারে কাপড়ের দোকানদার। সামান্য দোকানদার হলেও সারা কলকাতার মানুষ তাঁকে চিনতেন। কেননা সেই সময়ের কুখ্যাত ডাকাত মোহনকে বুদ্ধিবলে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তিনি সাধারণের স্বস্তির কারণ হয়ে বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন।
চৈতন্যচরণ দীর্ঘজীবী মানুষ ছিলেন না। মতিলালের বয়স পাঁচ বছর হতে-না-হতে তিনি হঠাৎই একদিন মারা গেলেন। আকস্মিক এই দুর্ঘটনায় মতিলাল ও তাঁর মা বেশ আতান্তরে পড়লেন। তাঁকে সহায়হীনা দেখে সুযোগ বুঝে জ্ঞাতিরা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আইনের প্যাঁচে ফেলে এমন নাস্তানাবুদ করল যে, ভিটেটুকু ছাড়া আর তাঁরা কিছুই বাঁচাতে পারলেন না। এই অবস্থায় মতিলালের বিধবা মা চোখে অন্ধকার দেখলেন। তাঁর অবস্থা দেখে এক জ্ঞাতির অবশ্য দয়া হল। তিনি বেজায় বড়লোক, বাবু বীরচাঁদ শীল। পাশে এসে দাঁড়ালেন।
বীরচাঁদের দাক্ষিণ্যেই মতিলালের বাল্যশিক্ষা শুরু হল। পাঠশালার পাঠ সেরে মি. মরটনের ইংরেজি স্কুল পেরিয়ে নিত্যানন্দ সেনের ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে তাঁর পড়াশুনো হয়ে গেল। এই অব্দি এসে বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্কে তিনি যে বুৎপত্তি অর্জন করলেন, তাই-ই হয়ে উঠল তাঁর সারাজীবনের সম্বল।
লেখাপড়া বেশিদূর না-এগোনর কারণটা এবার বলি। তা হল, যুগের প্রভাব। সেটা প্রবল বাবুয়ানির যুগ। অন্যের দেখাদেখি মতিলালও এই সময় পরের টাকায় বাবুদের উচ্ছৃঙ্খলতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন। মানুষ হিসেবে বীরচাঁদ ছিলেন প্রকৃতই শুভানুধ্যায়ী ও সজ্জন, তাই এই পরিস্থিতিতেও মতিলালের মাথার ওপর থেকে সাহায্যের হাত সরিয়ে নিলেন না। বরং সংসার হলে যদি বাবুয়ানির নেশা কাটে, এই আশায় তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মতিলালের বিয়ে দিলেন। বিয়েতে না-হলেও বিয়ের পরে পাকেচক্রে মতিলালের বোধোদয় হল।
রাজারাজড়ার গল্পে দেখি রাজপুত্রদের মধ্যে যাতে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বোধের বিকাশ হয়, সেজন্য তাঁদের দেশভ্রমণে বা তীর্থভ্রমণে পাঠাতেন রাজারা। এই ব্যাপারটাই মতিলালের জীবনে ফলপ্রসূ হয়ে উঠল। কেননা, বিয়ের পরই তাঁর শ্বশুর মোহনচাঁদ তাঁকে নিয়ে কাশী-বৃন্দাবন তীর্থভ্রমণে বেরুলেন। তখনও রেলগাড়ির যুগ আসেনি। কাজেই ভ্রমণ মানে, পায়ে হাঁটা ও জলপথে নৌকাই একমাত্র ভরসা। আর এতেই মতিলাল অবসর পেলেন মানুষ ও জীবনকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখার।
ভ্রমণের এই ধারা চলল ক্রমান্বয়ে সাত বছর। এই সাত বছর ধরে কলকাতার বাবুয়ানির চাকচিক্যের বাইরে মানুষের জীবন যে কি দুর্বিষহ যাতনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে, কাছ থেকে দেখতে দেখতে সেটা একদিন তিনি অনুধাবন করলেন। আর অমনি তাঁর বোধোদয় হল। বুঝলেন পরের অন্নে বিলাস অত্যন্ত অন্যায়। এতেই তাঁর জীবনযাপনে পরিবর্তন এসে গেল। ফলে, শেষবার ভ্রমণ সেরে তিনি যখন গৃহে ফিরলেন, তখন তিনি যেন একেবারেই অন্য মানুষ।
মতিলালের চরিত্রে সদগুণের অভাব ছিল না। তিনি ছিলেন ইংরেজি জানা, ব্যবসায়িক দূরদর্শী, মিষ্টভাষী, সত্যনিষ্ঠ, অকুতোভয় ব্যক্তিত্ব। এ-সব গুণের জোরে অল্পদিনেই তিনি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে নিত্য ব্যবহারের জিনিসপত্র জোগানোর কাজ জুটিয়ে ফেললেন। অচিরেই সকলের প্রিয় হয়ে দু’বছরের মধ্যেই উত্তরপাড়ার বালিখালের কাস্টমস দারোগা হয়ে গেলেন। কিন্তু সরকারি চাকরি করতে তাঁর ভালো লাগল না, ছেড়েছুঁড়ে নেমে পড়লেন পুরদস্তুর ব্যবসায়।
ব্যবসায় নেমেই ফাটকা বাজারে সস্তায় পেয়ে গেলেন কাঁচের শিশি ও কর্ক। বুঝলেন, ধরে রাখলে লাভ আছে। কিছুদিনেই হিসেব গেল মিলে। ব্যস, হয়ে গেল এক ধাক্কায় কয়েক লক্ষ লাভ। নেমে পড়লেন লাভজনক দেশি পণ্য নীল, চিনি, চাল ও সোরার ব্যবসায়। ক্রমে এই সমস্ত পণ্য সম্পর্কে তিনি এত অভিজ্ঞ হয়ে উঠলেন যে, চোখ বেঁধে দিলেও শুধু স্পর্শ করেই ভালো নীল চেনার ক্ষমতা অর্জন করে ফেললেন। একবার এক সাহেবের সঙ্গে বাজি ধরে সেই ক্ষমতার প্রমাণও দিয়ে দিলেন। পাশাপাশি অল্প সময়ে হয়ে উঠলেন জাহাজের মাল কেনাবেচায় নামকরা মুৎসুদ্দি। এক থেকে ক্রমে আট-ন’খানা কোম্পানির বাঁধা মুৎসুদ্দি হয়ে উঠলেন। তাঁর কাজ হল, কোম্পানিগুলোর মাল জাহাজ থেকে এদেশের বাজারে বিক্রি করে দেওয়া এবং দেশি মাল সংগ্রহ করে জাহাজ ভরে দেওয়া।
এই ভাবে নিজের ব্যবসার লাভ ও পরের ব্যবসা থেকে পাওয়া কমিশনে তিনি ক্রমে প্রচুর অর্থের মালিক হয়ে উঠলেন। তখন শুরু করলেন জমিদারি কেনাবেচা করতে। সমগ্র কলকাতায় তখন দ্বারকানাথের পরেই দ্বিতীয় বড়লোক হয়ে উঠলেন তিনি। জমা রেখে নয়, ব্যবসায় টাকা খাটিয়ে টাকা বাড়াতেই তিনি ভালবাসতেন। ভালবাসতেন রিস্ক নিতে। রিস্ক নিয়েই নেমে পড়েছিলেন জাহাজের কারবারে। হয়ে উঠেছিলেন ক্রমে বার-তেরখানা জাহাজের মালিক।
১৮৩৬ সালে জাহাজের ব্যবসা শুরু করলেও এই ব্যবসার মোড় ঘোরে ১৮৩৯ সালে বন্ধকী কারবারের সূত্র ধরে। এই সময় ‘হেনরি ডসন এন্ড বেস্টেল কোম্পানি’ নব্বই হাজার টাকায় দুটি জাহাজ মতিলালের কাছে বন্ধক রেখে সময়ে সেই টাকা শোধ দিতে পারল না। শর্ত অনুযায়ী, মতিলাল জাহাজ দুটির অধিকার পেয়ে গেলেন। ইংরেজের কোম্পানি অনেক চেষ্টা করল তাঁকে আটকাতে। কিন্তু হুমকি হুঁশিয়ারি দিয়েও ইংরেজ রাজত্বে তারা তাঁকে দমাতে পারল না-তিনি তখন এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন! জাহাজের মালিক হয়ে তিনিই এদেশে প্রথম অন্তর্বাণিজ্যে বাষ্পচালিত জাহাজের ব্যবহার শুরু করেন। এবং কলকাতা বন্দরে তিনিই প্রথম টানা-জাহাজের প্রচলন করেন।
এভাবে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়ে ১৮৪৭ সালে মতিলাল ব্যবসার জগত থেকে স্বেচ্ছায় সরে আসেন। আত্মনিয়োগ করেন অর্জিত অর্থ ও সম্পত্তির একটি বড় অংশ সমাজের উন্নতির কাজে লাগানোর কাজে। অবশ্য এ-কাজ তিনি অনেক আগেই শুরু করে রেখেছিলেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কয়েকজন ধনী ও সংস্কারমুখী মানুষের সঙ্গে মিলে ‘ধর্মসভা’ নামে একটি সভা গড়ে তোলেন। যে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে ও স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগর চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন; ‘ধর্মসভা’র মাধ্যমে সেই বিধবা বিবাহের প্রবর্তন ও স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে তাঁর বহু আগেই মতিলাল উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল ‘সমাচার দর্পণ’ সংবাদপত্রে তার সাক্ষ্য আছেঃ
‘…আমরা অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোকের স্থানে শুনিলাম সভার প্রধান কার্য এই যে এতদ্দেশীয় সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোকদিগের বিদ্যাশিক্ষার্থ চেষ্টা করিবেন এবং ব্রাহ্মণদিগের কুপরামর্শেতে শিশুকালাবধি বিধবার বিবাহ নিষেধ বিষয়ে যে কুসংস্কার হইয়াছে তাহাও বিনষ্ট করিতে হইবেক…।’
শুধু তাই নয়, মতিলাল এই সময় প্রথম বিধবা-বিবাহকারীকে কুড়ি হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। শোনা যায়, এক ব্যক্তি তাতে উৎসাহী হন এবং বিধবা বিবাহ করেন।
ছেলেবেলায় পড়াশুনো করতে গিয়ে মতিলাল বুঝেছিলেন এ-দেশে যতক্ষণ না স্বল্পবেতনের বা অবৈতনিক বিদ্যালয় তৈরি হবে, ততদিন পর্যন্ত বিদ্যা সকলের হয়ে উঠবে না। কেননা, বেশি বেতন দিয়ে পড়ার সামর্থ্য সকলের নেই। তাই ১৮৪৪ সালে মাত্র এক টাকা বেতনের বিনিময়ে বই-খাতা-কাগজ-পেন্সিল প্রভৃতি দানের মাধ্যমে আড়াইশো ছাত্র নিয়ে একটি প্রাথমিক স্কুল খোলেন। নাম দেন, ‘শীল’স কলেজ’। কিছুদিন পর স্কুলটি পুরো অবৈতনিক করে দেন। তখন স্কুলের নাম হয়, ‘শীল’স ফ্রি কলেজ’। স্কুলে একইসঙ্গে ভালোমানের ইংরেজি ও বাংলা পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করেন। স্কুলটি এখনও কলুটোলায় সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের ওপর স্বমিমায় বিরাজমান। উল্লেখ্য যে, এই স্কুলেই একদা পরবর্তীকালের পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ নিয়েছিলেন।
মতিলাল শীল না-থাকলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হসপিটাল আজকের সর্বজনীন রূপটি পেত না। প্রথমে তা শুধুমাত্র ইংরেজের চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল। তাকে সর্বসাধারণের করতে সম্প্রসারণের জন্য ১৮৩৫ সালে তিনি বারো হাজার টাকা ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকের বিস্তৃত জমি দান করেন। ১৮৪০ সালে দেশীয় ছেলেমেয়েরা যাতে ডাক্তারি শিখতে আগ্রহী হন, তার জন্য এক লাখ টাকা দান করেন। হাসপাতালে তাঁর নামে একটি ওয়ার্ড আছে। এই হাসপাতাল ছাড়াও এই সময় প্রসূতিদের জন্য একটি আলাদা হাসপাতাল তিনি তৈরি করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন কলকাতার বুকে বেশ কয়েকটি দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র।
মতিলাল সেই সময় অনেক অনাথ ও বিধবার জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে তাঁর মাসে ছয় থেকে সাতশো টাকা ব্যয় হত। বেলঘরিয়ার রথতলায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত অতিথিশালা ও ঠাকুরবাড়িতে সেই সময় প্রতিদিন পাঁচশো থেকে হাজার লোককে অন্নদান করা হত। বি টি রোডের ওপর এখনও তাঁর এই প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সামাজিক সংস্কারমূলক কাজ যেমন মতিলাল অকাতরে অংশগ্রহণ ও অর্থব্যয় করেছেন, তেমনি কত লোকের দিকে যে ব্যক্তিগতভাবে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার ইয়ত্তা নেই। ধনী তো অনেকেই হন, অর্থ তো অনেকেই সঞ্চয় করেন; কিন্তু পরের হিতে ক’জন এভাবে বিলিয়ে দিতে পারেন! মতিলাল সেই উদারতার আকাশ স্পর্শ করতে পেরেছিলেন বলেই আজ দুই শতাব্দী পেরিয়েও তিনি বাঙালির গর্বের সরণিতে স্মরণীয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে মৃত্যুর এত বছর পরেও তিনি স্বমহিমায় জীবিত। কেননা-‘কীর্তির্যস্য স জীবতি’…