"ইফ উই প্রে, উই উইল বিলিভ। ইফ উই উইল বিলিভ, উই উইল লাভ। ইফ উই লাভ, উই উইল সার্ভ।"
আমরা যদি প্রাথর্না করি তাহলে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করব। যদি বিশ্বাস করি, তাহলে ভালোবাসতে পারব। যদি আমরা ভালবাসি তাহলে সেবা করতে পারব।
ছোট খাটো গড়ন। নীল পাড় শাড়ি। ক্রশ দিয়ে আটকানো। হাতে রোজারি। সমাহিত, প্রশান্ত মুখ। আর আকাশের মতো হৃদয়।
১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট তাঁর জন্ম। যুগোস্লোভাকিয়ার স্কপিয়ে শহরে। এখন যে ম্যাসিডোনিয়ায়।বাবা নিকোলাস বোজোশিউ কাঠের কাজ করতেন। খুব ছোটবেলায় বাবার মৃত্যু হয়।
মা ড্রানা। তাঁকে মানুষ করেন আধ্যাত্মিক আবহে।বয়সের তুলনায় অনেক বেশি গম্ভীর। তাঁর এক ভাই এবং বোনও ছিল। বছর ১২ যখন বয়স তখনই স্থির করে ফেলেন ভবিষ্যৎ জীবনের লক্ষ্য। সেবার জীবনকেই বেছে নেবেন।
সেই বয়স থেকে দুঃস্থ মানুষের সেবায় এগিয়ে যেতেন। মানুষের অসহায়তা দেখলে স্থির থাকতে পারতেন না। জেসুইট মিশনের এক রিপোর্ট থেকে জানতে পারেন বাংলা আর বাংলাদেশের কথা। তিনি তখন থেকেই এখানে আসার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৬ বছর বয়সে আয়ারল্যান্ডে মিশনারি হিসেবে যোগ দিলেন সিস্টার্স অফ লোরেটো সংস্থায়। দু’বছর কাজ করার পর তাঁকে দেওয়া হল নতুন নাম। অ্যাগনেস থেকে টেরেসা। তিনিই পরিচিত হলেন ‘সিস্টার টেরেসা’ নামে।
১৮ বছর হতেই স্কুলের পাঠ কোনরকমে শেষ করেই সিদ্ধান্ত নিলেন গৃহ ত্যাগের। তাঁর মা বাধা দেননি। বরং ঈশ্বরের পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েকে। সেই শেষ আর কোনোদিন পরিবারের কারুর সঙ্গে দেখা হয়নি তাঁর।
সালটা ১৯২৯। টেরেসার জাহাজ ভিড়ল গঙ্গার কূলে। কলকাতায়। দার্জিলিং-এর কনভেন্টে যোগ দিলেন শিক্ষিকা হিসেবে। ১৫ বছর সেখানেই এক কনভেন্ট স্কুলে হেডমিস্ট্রেসের দায়িত্বে। কিন্তু কোথাও যেন অন্য টান অনুভব করছিলেন তিনি। ১৯৩১ সালে পুরোপুরি সন্ন্যাস জীবনে প্রবেশ করলেন।
১৯৪৬ এ হঠাৎ ভিতর থেকে অন্য ডাক আসল। যে ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। যে ডাকের অপেক্ষায় ঘরছাড়া। দেশ ছাড়া। শেষ পর্যন্ত সেই পথে নামার ডাক পেলেন তিনি। ফিরে এলেন কলকাতায়।
১৯৪৮- এ পোপের অনুমতি নিয়ে তিনি ১৪ নং ক্রিক লেনের একটি ছোটো ঘরে কাজ শুরু করলেন। অসহায় মানুষের সেবার কাজ। ১৯৫০-এ শুরু হল ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’।
মতিঝিল বস্তিতে একটি গাছের তলায় শুরু করেন প্রথম স্কুল। মাটির মেঝেতে আঁক কেটে শিশুদের বাংলা-ইরেজি অক্ষর চেনাতেন। শিক্ষাদান আর সেবা। তার মধ্যে দিয়েই ‘মা’ হয়ে ওঠার জার্নি। আর কোনও মন্ত্র তাঁর ছিল না। কেবলমাত্র ভালবাসা ছাড়া।
যে সময় তিনি কুষ্ঠরোগীদের জন্য ভবন গড়ে তোলেন সে সময় ভারতে কুষ্ঠ রোগ নিয়ে কোনও সচেতনতা ছিল না। কারুর এই রোগ হলে তাকে পরিত্যাগ করা হত। সমাজ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন। চিকিৎসা ব্যবস্থায় অমিল। রাস্তা থেকে সেই সব রোগীদের তুলে আনতেন তিনি। কুষ্ঠ রোগীদের জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।
অনাথ শিশু, গৃহহারা আতুর অসহায়দের মূল স্রোতে ফেরানোর চেষ্টা চলত এভাবেই। তিনি বলতেন, কুষ্ঠ নয়, যক্ষা নয়, মানুষের সবচেয়ে বড় অসুখ-ভালোবাসাহীনতা। কেউ কাছে টানে না। কেউ ফিরে তাকায় না। এই বোধ’। তাই রাস্তার দিকে তাকানো দরকার। কত অসহায় মুখ। গৃহহারা, পথে ঠাঁই নেওয়া মানুষ। খিদের জ্বালায় ধুঁকতে থাকা শিশু সবাইকে কাছে টেনে নিতেন তিনি। নিরলসভাবে।
মাদারের বাসভবনের পাশেই গড়ে তোলেন পরিত্যক্ত, অনাথ শিশুদের আশ্রয়। ১৯৫২ তে নির্মল হৃদয়।হোম ফর দ্য ডাইং।
তিনি তখন কালীঘাটের নির্মল হৃদয়ে রোগীদের সেবায় ব্যস্ত। এক সিস্টার এসে তাঁকে বললেন এক বিদেশী ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছে। মাদার শুনলেন। কিনু নিজের কাজ ছেড়ে গেলেন না। যে রুগীর শুশ্রষা করছিলেন তাঁর কিছুটা উপশম হলে তিনি সেই সেই ব্যক্তি তাঁকে মোটা অঙ্কের ডোনেশন দিতে চেয়েছিলেন।কিন্তু তাঁর আচরনে অহং মাদারের নজর এড়ালো না। সেই ভদ্রলোককে তিনি বললেন, ‘ আপনার দেশেও তো বহু অসহায় বৃদ্ধ, দুঃস্থ মানুষ আছেন যাঁদের গৃহের প্রয়োজন, শুশ্রষার প্রয়োজন, আপনি সেখানে কেন কিছু করছেন না। অসহায় মানুষের সেবার জন্য আমাকে আমার দেশের মানুষ তাঁদের সাধ্যাতীত সাহাজ্য করছেন।’। মাদার ফিরিয়ে দিলেন তাঁকে।
মাদার কখনও বিশ্রাম নিতেন না। ঠোঁটের কোণে লেগেই থাকত হাসির স্নিগ্ধতা। সেই মেজাজ ছড়িয়ে পড়ত বাকিদের মধ্যেও। সিস্টার থেকে ভলেন্টিয়ার সকলেই।
যেদিন পথে নেমেছিলেন সেদিন তাঁর সম্বল বলতে ছিল শুধুমাত্র ৫ টাকা আর মানবদরদী এক মানবদরদী হৃদয়। সেখান থেকেই আলোক যাত্রার শুরু। দীর্ঘ পথে মহীরুহের গায়ে ঝড়-ঝাপটা , দুর্যোগের আঁচ লেগেছে অনেক। কিন্তু মুখের হাসি ও মানুষের প্রতি বিশ্বাস অমলিন থেকেছে। এই কঠিন হৃদয় শহরে ভালোবাসার স্বর হয়ে অ্যাগনেস হয়ে উঠেছিলেন আর্তের দেবী। সবার মা। সেন্ট টেরেসা।
(ছবি ঃ রঘু রাই)