মনোরঞ্জনের অত্যন্ত আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে সখীর দলের নাচ থাকত তখনকার ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক নাটকে। তখন মানে, গত শতকের দুই তিনটি দশকে এবং তার আগে। সেই গত শতকেরই দ্বিতীয় দশকে মাত্র আট বছর বয়সে সখীর দলে নাচতে এসেছিলেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত অভিনেত্রী মলিনা দেবী। মিনার্ভা থিয়েটারের রঙ্গমঞ্চে।
সংসারে বড় অভাব তখন। হবে নাই বা কেন, দেশে ইংরেজের শাসন, মুক্তির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম, মধ্যবিত্তের দিন আনি দিন খাই অবস্থা, গাঁ থেকে উঠে আসা জ্ঞাতিগুষ্টির ভিড়ে প্রতিটি সংসার প্রায় হরি ঘোষের গোয়াল, পৃথিবী জুড়ে বেজেই চলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দেউলে দামামা। এমন পরিস্থিতিতেই ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে মলিনার জন্ম।
পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তাতেও বাঙালির গেরস্থে গানবাজনার রেওয়াজ ছিল, নাচগানের চল ছিল, ভাট-বোষ্টমের যাতায়াত ছিল। পাড়ায় পাড়ায় পালাকীর্তনের আসর বসত, রাস্তায় সঙ বেরোত, পালপার্বনে মঞ্চ বেঁধে শখের যাত্রাপালার আয়োজন হত। শৈশব থেকে সে-সব দেখতে দেখতেই নাচ বলুন, গান বলুন বা অভিনয়; সব ক'টির ওপরই মলিনার বড় মায়া পড়ে গেল, ভালোবাসা জন্মাল।
কিন্তু, ভালোবাসলেই তো আর হল না, সংসারের হাঁড়ির হালে শখ করে কী আর ভালোবাসার হাত ধরা যায়! তবুও পথ খোলে বৈকি। কখনও সামর্থ্য পথ খোলে, কখনও অভাব। মলিনার পথ খুলল দ্বিতীয়টি। অভাবের সংসারে খবর এল, থেটারে সখীর দলে নাচের জন্য মেয়ে চাই, বাচ্চা মেয়ে, শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া হবে, শিখতে পারলে মিলবে মাস শেষে মাইনে। মাইনে হয়তো হিসেব মতে যৎসামান্য, কিন্তু অভাবে তাও যে মহার্ঘ্য!
মিনার্ভার বাঁধা নাচের মাস্টার ললিতমোহন গোস্বামী। তাঁর কাছে শুরু হল তালিম। মলিনা শিখতে লাগলেন মনপ্রাণ দিয়ে। একে ভালোবাসার জিনিস, তার ওপর সংসারের ভবিষ্যৎ যে তাঁর এই শেখাটুকুর ওপরই নির্ভর করছে, এটা আট বছরের মলিনা হাড়ে-মজ্জায় বুঝে এসেছিলেন। অবুঝ বয়সে বোঝার বোঝা যে কতবড় ভার, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কে আর বোঝে! ফলে, দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে রইলেন মলিনা।
নাচ শিখতে শিখতে আর ফাইফরমাস খাটতে খাটতে সখীর দলে একদিন জায়গা মিলে গেল। 'মিশর কুমারী', 'কিন্নরী', 'আত্মদর্শন' প্রভৃতি নাটকে। নাচিয়ে-শিল্পী হিসেবে মলিনার বেশ নাম হল কিছুদিনের মধ্যেই।
পেশাদার রঙ্গমঞ্চগুলো তখনও একে-অপরের শিল্পী ভাঙিয়ে নিয়ে আসার কয়েক দশকের ঐতিহ্য বহালতবিয়তে বজায় রেখে চলেছে। সেই ঐতিহ্যেই অল্পদিনে ডাক পেলেন মলিনা, মনমোহন থিয়েটার থেকে। পেলেন মাইনে বেশি পাওয়া আর অভিনয়ে সুযোগ পাওয়ার আশ্বাস। মলিনা যোগ দিলেন, কথা রাখল মনমোহন। 'জাহাঙ্গীর' নাটকে বালক দারার চরিত্রে অভিনয় করে অভিনয়ে হাতেখড়ি হল মলিনার। সামান্য প্রশংসাও জুটল।
ডাক পেলেন স্টার থিয়েটার থেকে। 'শকুন্তলা' নাটকে নেচে বেশ নাম হল।
তখন নির্বাক সিনেমার যুগ। নাটকের উজ্জ্বল অভিনেতাদের ডেকে ডেকে সিনেমায় নিয়ে আসার যুগ। কাজেই স্টারে অভিনয় ও নাচের সুনামের সূত্রে ডাক এল সেই নির্বাক সিনেমার জগৎ থেকেও। মলিনা সেই ডাকে সাড়া দিলেন। অভিনয় করলেন রাধা ফিল্মসের 'শ্রীকান্ত' ছবিতে। সময়টা, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ।
বেশ কয়েকটি নির্বাক ছবিতে অভিনয় করতে করতেই চোখের সামনে এসে গেল সবাক ছবির যুগ। ডাক পেলেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও থেকে। অভিনয় করলেন 'চিরকুমার সভা' ছবিতে। 'নির্মলা' চরিত্রে। সকলের প্রশংসায় ধন্য হলেন।
তখন নিউ থিয়েটার্স বাংলা, হিন্দি, উর্দু--এই তিন ভাষাতেই ছবি তৈরি করত। ফলে, কোম্পানির বাঁধা আর্টিস্ট হিসেবে তাঁকে হিন্দি ও উর্দু শিখতে হল। গান শিখতে হল রাইচাঁদ বড়ালের কাছে, অভিনয় শিখতে হল অমরদাস মল্লিকের কাছে।
ক্রমে স্টুডিও-প্রযোজনার দিন শেষ হয়ে এল একক প্রযোজনার যুগ। বাঁধা মাইনের কাল পেরিয়ে এল ছবি-প্রতি পারিশ্রমিক পাবার দিন। এল স্বর্ণযুগ। ততদিনে ধীরে ধীরে মলিনা স্বনামধন্য হলেন, রাইচাঁদের ভাই জলু বড়ালকে বিয়ে করে সংসারী হলেন, সিনেমা ও রঙ্গমঞ্চের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেত্রী হলেন, দেশি-বিদেশি পুরস্কার অর্জন করলেন, 'মহিলা শিল্পী মহল' প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিলেন, 'আমোদ' পত্রিকায় পূর্ণিমা দেবী ছদ্মনামে গান লিখলেন, প্যারোডি লিখলেন, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে প্রযোজনা সংস্থা 'এম জি এন্টারপ্রাইজ' গড়ে তুললেন, আর তার সঙ্গে বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় দুশোর বেশি ছবিতে অভিনয়ও করলেন।
তারই মধ্যে 'ঠাকুর রামকৃষ্ণ', 'বড়দিদি', 'গৃহদাহ', 'সাত নম্বর বাড়ী', 'রাণী রাসমণি', 'রামের সুমতি', ছোটা ভাই', 'বিন্দুর ছেলে', 'নিষ্কৃতি', 'সাড়ে চুয়াত্তর', 'শ্যামলী' প্রভৃতি ছবিতে তাঁর বহুমাত্রিক অভিনয় বাংলা সিনেমার ইতিহাসে স্বাভাবিক কলা-নৈপুণ্যের দিক থেকে 'মাইল স্টোন' হয়ে রইল, তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখল ভাবীকালের আখরে...
তথ্যঋণ : 'সোনার দাগ'- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ।