রবীন্দ্রনাথ মোহিতলাল মজুমদারের কাব্য প্রসঙ্গে 'অকৃত্রিম পৌরুষ' কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অনেক কবি ও তাঁদের কবিকৃতির উদার-প্রশংসা করেছেন, কিন্তু এত বড় শ্লাঘার কথা আর কারও সম্পর্কেই বলেননি।
এমন যে কবি-মোহিতলাল, তিনিও কিন্তু ব্যক্তি-মোহিতলালের পৌরুষ-প্রাবল্যের জন্যই সাহিত্য-সমাজে একদা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। কারণ, তাঁর এই দুই সত্তার মধ্যে কোন বিরোধ ছিল না। থাকলে তাঁর পক্ষে অন্তত ভালো হত। তিনি নিজেকে বড্ড বেশি ভালোবাসতেন এবং অপরের প্রতি সহজেই সাহিষ্ণুতা হারাতেন। 'শনিবারের চিঠি'র সান্নিধ্যে এসে তাঁর চরিত্রের এই দুটি দিক ক্ষুরধার হবার সুযোগ পেয়েছিল। এরই ফলে এই পর্বে তাঁর জীবনে অজস্র বন্ধুবিচ্ছেদ হয়েছে। ক্রমশ একা হয়েছেন। তাতে খেদ হয়নি, আত্ম-অভিমান জেগেছে মনে। লিখেছেন:
"আমারে তোমরা ভুলে যেও ভাই!
এসেছিনু পথ ভুলে--
পান করিবারে জাহ্নবী-বারি
কীর্তিনাশার কূলে!"
সাহিত্যের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল, এটা তিনি নিজে যেমন জানতেন, তেমনি অন্যেরাও জানতেন। ফলে, কেউ তাঁকে ভুলে যাবে, এটা তিনি মানতে পারেননি। তাই জীবন সায়াহ্নে তাঁর প্রতি যখন সাহিত্য-সমাজের নীরবতা নির্দিষ্ট হল, তখন তিনি এর পেছনে নবীন সাহিত্যিক গোষ্ঠী এবং পত্রিকামণ্ডলীর কলকাঠি দেখতে পেলেন।
কবি হওয়া মোহিতলালের নিয়তি ছিল। কেননা, দুই দিকপাল কবি ঈশ্বর গুপ্ত এবং কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে মোহিতলালের পারিবারিক আত্মীয়তা ছিল। তার মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ সেনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তিনি দীর্ঘকাল পেয়েছেন। তাঁর কবিতা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে মোহিতলাল আবৃত্তি করতেন।
দেবেন্দ্রনাথের কবিতা ভালো লাগলেও মোহিতলাল কিন্তু অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা থেকে। তবে তাঁর প্রভাব কাটিয়ে উঠে তিনি স্বকীয় পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। এবং, স্বভাববশত অচিরেই সত্যেন্দ্রনাথের বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন। সেই বিরোধী মনোভাব নিয়ে 'মোসলেম ভারত' পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দ, ভাদ্র মাসের সংখ্যায় প্রকাশিত চিঠিতে সত্যেন্দ্রনাথ ও তাঁর কবিতা সম্পর্কে ইঙ্গিতে মোহিতলালের লিখতে বাধেনি যে :
"...ছন্দ কবিতার শব্দার্থময়ী কণ্ঠ ভারতীর ভূষণ না-হইয়া, প্রাণের আকুতি ও হৃদস্পন্দনের সহচর না হইয়া, ইদানীং কেবলমাত্র শ্রবণ প্রীতিকর প্রাণহীন চারু চাতুরীতে পর্যবসিত হয়েছে...।"
শুধু ব্রাহ্ম কবি সত্যেন্দ্রনাথ নয়, ব্রাহ্মদের প্রতিও তাঁর যথেষ্ট বিরূপতা ছিল। একমাত্র রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে সেই সমাজের হোতাদের দেদার নিন্দে করে তিনি আনন্দ পেতেন। "প্রবাসী" পত্রিকার প্রতিও তাঁর কোন কারণে বিরূপতা ছিল, নজরুলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই ওই পত্রিকায় কোনদিন না-লিখতে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন। এভাবে নিজের ভাবনা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে তাঁর কোন দ্বিধা ছিল না। তিনি নজরুলের কবিতাকে আগবাড়িয়ে প্রশংসা করেছেন, অযাচিতভাবে নিজেই তাঁর মেন্টর-'গুরু' সেজে বসেছেন, আবার ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিয়ে কবিতাও লিখেছেন। এটা ঘটনা। এমনই অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ ছিলেন মোহিতলাল।
আসলে, বাংলা কবিতা বা সাহিত্য-জগতে ত্রিশ বা চল্লিশের কবি-সাহিত্যিকদের প্রকাশভঙ্গি মোহিতলালের পছন্দ হয়নি। কারণ, সাধারণের মুখের ভাষা যে সাহিত্যের ভাষা হবার যোগ্য, এটাই তিনি মানতে পারতেন না। সাহিত্য-স্বভাবে তিনি ছিলেন ক্লাসিকধর্মী। সাহিত্যে দারিদ্র্য ও যৌনতার প্রকাশভঙ্গি নিয়েও তিনি নবীনদের বিরোধী। সেখানেও তিনি প্রাচীনপন্থী। তাঁর মত ও সাহিত্যাদর্শের সঙ্গে যাঁদের মেলে না, তাঁদের প্রতিই তিনি বারে বারে অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন। এই মানসিকতা থেকেই 'কল্লোল' পত্রিকা ও তার নবীন সাহিত্যিকদের 'মাছিদের কল্লোল' বলে সম্বোধন করতে তাঁর দ্বিধা হয়নি। তাঁদের সাহিত্যকে বলতে দ্বিধা হয়নি, 'শিশ্নোদরপরায়ণ'। তাঁদের সাহিত্যের আয়ুকে বলতে দ্বিধা হয়নি 'বিড়ি ও দেশলাই'-এর মতো।
এ-সবই হচ্ছে মোহিতলালের জীবনের নেতিবাচক ইতিহাস। তাঁর জীবনে-সাহিত্যে কী কোন ইতিবাচক দিকই ছিল না? ছিল বৈকি:
সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল, তিনি সাহিত্যকে বড় ভালোবাসতেন। কবিতাকে বড় ভালোবাসতেন। স্বরচিত নতুন কবিতা কাউকে না-শোনানো পর্যন্ত তাঁর স্বস্তি ছিল না। না-শোনানো অব্দি সেই কবিতা পকেটে পকেটে তাঁর সঙ্গী হয়ে ঘুরত। পথে-ফুটপাথে পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে সেখানে দাঁড়িয়েই কবিতাটি না-শোনানো অব্দি তাঁর স্বস্তি ছিল না। শুধু নিজের না, অন্যের লেখা অথচ তাঁর পছন্দের কবিতা আবৃত্তি করে শোনানোর ব্যাপারেও এই ভাবাবেগের দ্বৈধতা ছিল না।
যাঁরাই মোহিতলালের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরাই নত হয়েছেন তাঁর পাণ্ডিত্যের পাদদেশে। তিনি বাংলা সমালোচনা সাহিত্যকে একইসঙ্গে ভাষায় সুললিত ও যুক্তির ক্ষুরধারে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর সেই মূল্যায়নে সহমত হন এখনও অনেক শিক্ষক-ছাত্র-পাঠক। ফলে বলা যায় যে, তাঁর সাহিত্যের এই ধারাটি অন্য ধারার চেয়ে কলোত্তীর্ণ।
মানুষ হিসেবে মোহিতলালকে অনেকেরই আত্মঘাতী মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁরা এও মেনে শ্রদ্ধানত হবেন যে, মোহিতলাল মেরুদণ্ডহীন ছিলেন না। ভুল হোক বা ঠিক, নিজের বিশ্বাসের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ আস্থা। তাই সাহিত্য-সমাজে কোণঠাসা হয়েও সেই বিশ্বাস থেকে সরে আসার বা কারও কাছে নত হওয়ার কোন কারণ তিনি দেখেননি, শুধুমাত্র মেরুদণ্ডের জোরেই। সেই জোরেই সঞ্চয়হীন জীবন মধ্যাহ্নে যখন অর্থাভাব এসে ঘিরল, ছেলেদের পড়ানোর সামর্থ্য রইল না; তখন অনেক শুভানুধ্যায়ীই বিনা বেতনে পড়ার আর্জি নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে বললে, তিনি উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন: 'কেন, ওদের বাবা কি মরে গেছে!' বিশ্বাসের সঙ্গে এই সততা তাঁর আজীবন ছিল।
হুগলির বলাগড়ে মোহিতলালের জন্ম। একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো এবং সেখানকার শিক্ষক নিবাসে কয়েকবছর থাকা--এই ছিল পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তাঁর যোগ। সেই যোগ যে কতটা গভীর হয়ে উঠেছিল, কতটা মমত্বময় হয়ে উঠেছিল সেটা বোঝা যায়, দেশভাগের সময় তাঁর আবেগের বহিঃপ্রকাশ থেকে। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের সন্ধ্যায় দেশভাগের খবর পেয়ে দুঃখে, মর্মবেদনায় সারারাত তিনি ঘুমনোনি। সারারাত তাঁর বিনিদ্র চোখে জল ঝরেছে! ঘটনাটা আর কিছু নয়, একজন সত্যিকারের সৎ-আবেগপ্রবণ মানুষের প্রতিচ্ছবিকেই স্পষ্ট করে। সৎ-আবেগ না-থাকলে সত্যিকারের সাহিত্য হয় না। মোহিতলালের মধ্যে এ-দুয়ের কোনও অভাব ছিল না।
মোহিতলাল নিজের একরোখামির জন্য যুগের থেকে, সাহিত্যের প্রগতিশীল ধারাটি থেকে ক্রমে সরে এসেছিলেন ঠিকই, বিরোধীতায় সকলের বিরাগভাজন হয়েছেন ঠিকই; তবু মহাকালের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের স্বর থেকে সরে এসে অন্য সুরে বাংলা কাব্যের ধারাকে আধুনিকতম খাতে বইয়ে দেবার ভগীরথ হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল, যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনিও সমান মর্যাদায় তিরিশের কবি ও পরবর্তীকালের সমালোচকদের কাছে বন্দিত। প্রেমেন্দ্র মিত্র স্বীকার করেছেন তাঁর কবিতার 'সুতীব্র অথচ শাসিত স্বাতন্ত্র্যে'র কথা। সেখানেই মোহিতলাল আজও প্রাসঙ্গিক, সেখানেই মোহিতলালের জয়...