চেনা-অচেনা আলোয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত

টাকাপয়সার ব্যাপারে যুবক মধুসূদন খুব একটা হিসেব-নিকেশের ধার ধারতেন না। অনায়াসে এক মোহর খরচ করে তিনি ইংরেজি সেলুনে চুল কাটিয়ে আসতে পারতেন, কোচম্যান-কুলিকে মুঠোভর্তি টাকা বকশিশ দিতে পারতেন, ইয়ারবক্সীদের সাহেবি রেস্টুরেন্টে যখন-তখন ট্রিট দিতে পারতেন। কারণ, লাগে টাকা, দেন রাজনারায়ণ! রাজনারায়ণ দত্ত, মধুসূদনের পিতৃদেব--সাগরদাঁড়ির জমিদারপুত্র, কলকাতার নামকরা উকিল। বড়োলোকি ব্যাপারটা নিজে যেমন উপভোগ করতেন, তেমনি ছেলেকেও প্রাণ খুলে উপভোগ করতে শিখিয়েছিলেন তিনি!

উনিশ শতকের প্রথম দিকে একশ টাকা, মানে, অনেক টাকা। হিন্দু কলেজের ছাত্র মধুসূদন দত্তের সেটাই ছিল মাসিক হাত খরচ। এছাড়াও মায়ের কাছ থেকে উপরিটাও মন্দ জুটত না।  পালকিতে চড়ে খিদিরপুর থেকে কলেজে আসতেন, সঙ্গে আসত দুজন খিদমতি চাকর। তাদের সঙ্গে থাকত দু'তিন রকমের ইংরেজি কুর্তা; কারণ, সারাদিনের ক্লাসের মাঝে বাবু শ্রীমধুসূদন দু'তিনবার পোশাক পরিবর্তন করতেন। সৌখিন সাহেবিয়ানায় যতদূর যাওয়া যায়, রাজনারায়ণ ছেলেকে ততটাই উড়তে দিয়েছিলেন। বাপছেলে এক ছিলিমে তামাক খেতেন, রাতে শোবার আগে রোজ এক পেগ মদ পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তবু, সেই মুক্ত হাওয়ায় মধুসূদনের চরিত্রে নারীঘটিত কলঙ্ক কিন্তু লাগেনি--বাবু কালচারে মদ-মেয়েছেলে যেখানে আবশ্যিক কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছিল!

আসলে, মধুসূদন ছিলেন নিতান্তই ভাবলোকের বাসিন্দা। অন্তত এই পর্বে। আর্থিক অনটন ও অভাবের আঘাত উড়ন্ত মানুষকে রুক্ষ্ম বাস্তবের মাটিতে পা রাখতে বাধ্য করে। মধুসূদনের সে বালাই ছিল না। এমনকি, মধুসূদন যখন ধর্ম ত্যাগ করলেন, তারপরও দীর্ঘদিন বাবা তাঁর মাসোহারা বন্ধ করেননি। পরে করেছিলেন কোন এক অজ্ঞাত কারণে। যাইহোক, হিন্দু-পর্বে যখন তিনি শুধুই বিদেশি কাব্যলোকের  রাজা হওয়ার খোয়াবে মশগুল; তখন জানতে হোক বা অজান্তে নিতান্তই অনুকরণপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অত্যন্ত সচেতনভাবে তিনি ইংরেজদের ইংরেজি উচ্চারণের অনুকরণ করতেন, প্রিয় অধ্যাপক ক্যাপ্টেন রিচার্ডসনের অস্পষ্ট হাতেলেখার অনুকরণ করতেন এবং পোপ-স্কট-বায়রনের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। অসম্ভব মেধাবী মানুষটা এভাবেই নিজেকে সেইসময় শুধুই অনুকরণে ব্যস্ত রেখেছিলেন। এমনকি  বিখ্যাত কবিস্বভাবের অনুকরণ করতেও বাদ দেননি। তাই, সাহিত্যসেবীরা ভাষার কারবারি, তাঁদের হিসেব-ঠিকুজি গণিতশাস্ত্রের কী প্রয়োজন!--এই মানসিকতা ও উন্নাসিকতা থেকে তিনি গণিতশাস্ত্রকে উপেক্ষা করতেও শুরু করেছিলেন। এবং, হিন্দু কলেজে গণিতের ক্লাস তিনি করতেন না। সেই-সময়টা তিনি সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরিতে বসে হয় সাহিত্য চর্চা করতেন, নয়তো রিচার্ডসনের হাতেরলেখার নকলনবিশী করতেন। অথবা, বন্ধুদের নিয়ে সাহেবি রেস্টুরেন্টে খানা খেতে যেতেন।

বন্ধু ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একদিন মধুসূদনের তর্ক বেশ জমে উঠল--নিউটন বড়, না শেক্সপিয়ার বড়--তাই নিয়ে। ভূদেবও অসাধারণ মেধাবী ছাত্র। কিন্তু, মধুসূদন নিজস্ব যুক্তিতে তাঁকে দাবড়ে দিলেন--শেক্সপিয়ার চাইলেই নিউটন হতে পারতেন, কিন্তু, নিউটন চাইলেই শেক্সপিয়ার হতে পারতেন না--এই বলে! অমনি ভূদেব বললেন, বেশ, প্রমাণ দাও। মধুসূদন বললেন, দেব। প্রমাণ দেওয়ার অবসরও একদিন ঠিক জুটে গেল। কপালগুণে, মধুসূদন সেদিন ক্লাসেই ছিলেন। ক্লাসে গণিত-স্যার এমন কঠিন এক অঙ্ক দিলেন যে, যাঁরা নিজেদের নিউটনের ভাবশিষ্য ভেবেছিলেন, তাঁরা কেউ পারলেন না। শুধু তাঁরা কেন, ক্লাসের কেউ পারবেন বলে মনে হল না। তখন, উঠলেন মধুসূদন। তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্কখানা কষে বিজয়ীর মতো ফিরলেন ভূদেবের দিকে। মুচকি হেসে বললেন, বলেছিলাম না শেক্সপিয়র চাইলে নিউটন হতেই পারে--এবার বুঝেছ তো কথাটা ঠিক কি না!

গণিতের মতো এই যৌবন-পর্বে তাঁর উন্নাসিকতা বাংলা ভাষার প্রতিও সমানভাবে ছিল। তাঁর উন্নাসার মূল কথাই হল, আমি হয়তো ভাষাটা ভালো জানি--কিন্তু, নিজেকে সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে দেব না! চর্চা করব না। 'পৃথিবী'-কে 'প্রথিবী'-লেখাটা সেই উন্নাসারই এক ধরণের বহিঃপ্রকাশ। তবে, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর চার্চে পাদ্রীর মুখে বিদেশি উচ্চারণে বিদঘুটে বাংলা শুনে যে মানুষটি হেসে ফেলতে পারেন, তিনি যে বাংলা ভাষাটাকে রক্ত থেকে ধুয়ে ফেলতে পারেননি--এটা স্পষ্টই বোঝা যায়। যে মানুষটা বাংলায় দু'লাইন চিঠি লিখতে হলে ন্যাকামির একশেষ করতেন, সেই তিনিই হঠাৎ একদিন বন্ধুর সঙ্গে তর্কের খাতিরে জীবনের প্রথম নাটকটি দুম করে বাংলায় লিখে ফেললেন--ভেতরে ভাষাটি না-থাকলে কোন অলৌকিক উপায়েও এটা কিছুতেই সম্ভব হত না! আসলে, তাঁর নিজের তৈরি উন্নাসার কুয়াশায় তিনি এতটাই ঢেকে আছেন যে, সেটা না সরালে ভেতরের মধুকে মাঝে মাঝেই চেনা দায় হয়ে ওঠে--যে যুবক বাংলা এবং বাংলা ভাষাকে সত্যিই ভালোবাসতেন, অথচ নিজে জানতেন না! সত্যি বলতে কী, বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের মতো প্রতিভাবান বহুভাষাবিদ সাহিত্যিক সে-যুগে আর কেউ ছিলেন না।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...