গুলজার তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘উও সারি কায়নাত কে সিতারে থে’। উনি গোটা বিশ্বের তারা।
আঁখোঁ কা ভিসা নেহি লাগতা হ্যায়, সপনোঁ কি সরহদ হোতি নেহি
বন্দ আঁখোঁ সে রোজ চলা যাতা হুঁ সরহদ পার মিলনে মেহেদী হাসান সে।
মেহেদী হাসান। গজল সম্রাট। জন্ম ভারতে। বসত পাকিস্তানে। তবু তিনি দুই ভূমের সন্তান। কাঁটাতারের ধার ম্লান হয়ে গিয়েছিল তাঁর গানে গানে।
শিকড় ভারতে। কিন্তু পিতৃপুরুষের ভূমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল পাকিস্তানে। মনের মধ্যে বসত করত সোনালী বালির শহরটা। তাঁর গানের মেহফিলে রং জমাতে তাই কেশরিয়া বালমকে আসতেই হবে।
মরুভূমির প্রান্তরে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকের একা সুর ঝরে পড়ত গানে গানে। রাজস্থানী ক্ল্যাসিক সেই কারণেই এত মোহময় হয়ে উঠত মেহেদির গলায়। এদেশে তিনি ভিটে ছাড়া টান, হারিয়ে যাওয়া শিকড়ের পুরনো গন্ধ খুজে পেতেন।
রাজস্থানের ঝুন ঝুন জেলার লুনা গ্রামে। বাবা ওস্তাদ আজিম আলী খান এবং চাচা ওস্তাদ ইসমাইল খান ছিলেন ধ্রুপদী সংগীতের প্রখ্যাত পণ্ডিত। কালাওয়ান্ত ঘরানার তিনি ষোলতম প্রজন্ম। তাঁর পূর্বপুরুষরা নবাব-বাদশা-রাজদরবারের গাইয়ে ছিলেন। জয়পুর থেকে ইন্দোর ছাড়িয়ে নেপাল সব দরবারেই তাঁরা সম্মানিত অতিথি।
পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারা বহন করেই ছ’বছর বয়স থেকে গান শেখা শুরু করেন। উচ্চাঙ্গ সংগীতে দম ধরে রাখার জন্য রোজ ভোরে উঠে দৌড়াতে হত। রেওয়াজের অঙ্গ হিসেবে খেতে হত কাপ ভর্তি দেশি ঘি। বরোদার মহারাজার দরবারে প্রথম গান গান মেহেদী হাসান।
দেশভাগ বদলে দেয় জীবন। সারাজীবনেও সেরে উঠতে পারেননি সেই ক্ষত থেকে। হাতে মাত্র দশ টাকা নিয়ে শুরু করেছিলেন নতুন জীবন। তাই দিয়েই ফয়সালাবাদে একটি সাইকেল সারাইয়ের দোকান দেন। যদিও সারাতেন ট্র্যাক্টর। পরবর্তী বছরগুলো কেটে গেল কেবল দিন গুজরানের লড়াইতে টিকে থাকার চেষ্টায়।
১৯৫০- এ তাঁর গজল ‘গুলোঁ মেঁ রং ভরে’ সামনে আসে। গানপ্রিয় মানুষদের ছুঁয়ে গিয়েছিল সেই গান। মেহেদীর জনপ্রিয়তার শুরুয়াতটা এই গান দিয়েই।
মেহেদীর দাদা গুলাম কাদির একটি গজল লিখেছিলেন, ‘মহব্বত করনেওয়ালে কম না হোঙ্গে’। সেই গান সীমান্ত পার করে প্রবাদ হয়ে উঠেছিল গানপ্রেমি মানুষের কাছে।
মির্জা গালিব, ফৈয়জ আহমেদ ফৈয়জ, মীর তাকি মীর - এর লেখা গজল গাইতেন। মেহেদীর উর্দুতে কখনও কোনও আঞ্চলিক ছাপ পড়েনি।
সরহদেঁ নামে গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল। পাকিস্তানের মাটিতে বসে সেই গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন মেহেদী। ভারতের মাটি থেকে বাকিটুকু রেকর্ড করেছিলেন কিন্নরী লতা মঙ্গেশকর।
নিজের ভিটে একবার দেখার অভিলাষ ছিল। সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল।
মেহেদী বলতেন, ‘সংগীত তো দরিয়া হ্যায়, জিতনা উতরো উতনা আপনে আনজান হোনে কা পতা চলতা হ্যায়’
গানের প্রতি এই অধ্যাত্মবাদ তাঁর গানকে অন্য উত্তরণ দিয়েছিল। সব গজল আসলে ভুলতা না পারা বেদনার ফুল। কোনও ভুল নেই সেখানে।
রঞ্জিশ হি সহি দিল হি দুখানে কে লিয়ে
আ ফির সে মুঝে ছোড় কে জানে কে লিয়ে...