১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর, সে-বছরও পাঁজিতে ছিল অক্টোবরের আকাশ জুড়ে মেঘ, ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস। এই ৬ অক্টোবরই ঢাকার বংশাই নদীর ধারে শ্যাওড়াতলি গ্রামে জগন্নাথ সাহার স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হল। জগন্নাথ সাহা মুদির দোকানি ও হাঁটুরে ব্যবসায়ী, অবস্থা তেমন সচ্ছল নয়। তবুও কিন্তু এই প্রথম তাঁর সন্তান হচ্ছে না, এর আগে স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দুই ছেলে, দুই মেয়ের জন্ম দিয়েছেন।
যাই হোক, প্রসববেদনা উঠতেই গ্রামের ধাই এসে হাজির হল। সেকালে বসতঘরের বাইরে আলাদা করে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য আঁতুড়ঘর তৈরি করা হত। তো, সেই ঘরে আসন্নপ্রসবা ভুবনেশ্বরীকে আনা হল। আর তখনই আকাশ উথালপাথাল করে বজ্রবিদ্যুৎ গায়ে মেখে শুরু হল প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ের দাপটে উড়ে গেল আঁতুড়ঘরের খড়ের চাল। আকাশে শুরু হল অবিরত বজ্রনির্ঘোষ। আর সেই বজ্রনির্ঘোষের ঘনঘটার মধ্যেই জন্ম হল ভারতের ভাবী জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার।
ঝড়বাদলামেঘ নিয়ে জন্ম হয়েছিল বলে ঠাকুমা তাঁর নতুন নাতির নাম রাখলেন, 'মেঘনাথ'। কিন্তু, কয়েক বছর পর, মেঘনাথ যখন স্কুলে যাবার মতো হলেন, তখন স্কুলের খাতায় তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখা হল, 'মেঘনাদ'। এই নামটি মেঘনাদেরও নিশ্চয় বাল্যেই বেশ মনে ধরেছিল। তাই বোধ হয় পরবর্তীকালে মাইকেলের 'মেঘনাদবধ কাব্য' তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছিল, আর সব চেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছিল কাব্যের নায়ক, 'মেঘনাদ'। যদিও এই প্রিয় হয়ে ওঠাটা কেবলই নামের মিলের জন্য নয়; নায়ক মেঘনাদের জেদ, অনমনীয়তা, বীরত্বও তাঁর কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিল।
বাবার কোন ইচ্ছেই ছিল না মেঘনাদকে লেখাপড়া শেখানোর। শুধু মেঘনাদ কেন, জীবনে যে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার প্রয়োজন আছে--এ-কথা বিশ্বাসই করতেন না জগন্নাথ। তিনি শুধু জানতেন, মুদির ছেলে মুদি হবে; তিনি বুড়ো হলে ছেলেরা ব্যবসা সামলাবে, এটাই ভবিতব্য। এতে আর হাতিঘোড়া অত লেখাপড়া শেখার কী আছে! টাকাপয়সার হিসেবটুকু শিখলেই হল আর সামান্য অক্ষর পরিচয়টুকু হলেই যথেষ্ট। তাই বড়ছেলে জয়নাথের মেট্রিকের গণ্ডি আর পেরনো হল না। ঢাকায় ছুটতে হল এক ব্যবসায়ীর গদিতে কাজ শিখতে আর খিদমত খাটতে।
মেঘনাদের কপালেও অবশ্য এই ভবিতব্যই নাচছিল। পরিবেশে-পরিবারে কোথাও পড়াশোনার আবহাওয়া ছিল না, উৎসাহ দেওয়ারও কেউ ছিল না। তবুও তারই মধ্যে পড়ুয়ার স্বভাব নিয়ে কেমন করে যেন জন্ম নিয়েছিলেন মেঘনাদ। পড়তে না-পেলে তিনি কান্নাকাটি শুরু করে দিতেন। পড়ার জন্য প্রতিদিন খুব ভোরে উঠতেন। আর এ-সময় ভোররাত্তিরে জোরে জোরে পড়তে গিয়ে বাবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় মারও খেয়েছেন অনেকবার। তবুও, পড়াশোনা থেকে কেউ তাঁর মুখ ফেরাতে পারেনি।
সে-বার গ্রামের সরস্বতী পুজোয় ঠাকুর দেখতে গিয়ে আনমনে কেমন করে যেন দেবীর গায়ে তাঁর ছোঁয়াচ লেগে গেল। সেই সামান্য অপরাধেই এক নির্বোধ গোঁড়া পুরুতের কাছে চরম অপমানিত হলেন ছোট্ট মেঘনাদ। নীচুজাতের ছেলে বলে গালাগালি খেলেন। শুধু তাই নয়, জাতের নামে বজ্জাতি করে তাঁকে সেখান থেকে প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হল। ছেলেবেলার এই নিদারুণ অপমানের আঘাত তিনি আর কখনোই ভুলতে পারলেন না। এ-থেকেই সমস্ত দেবদেবীর পুজোর ওপর তিনি শ্রদ্ধা হারালেন, বিদ্যার দেবীর ওপর থেকেও তাঁর শ্রদ্ধা চলে গেল। কিন্তু, বিদ্যার ওপর হলেন আরও শ্রদ্ধাশীল। বুঝলেন দেব নয়, দেবী নয়, পরিবার নয়, পরিজন নয়--যা করতে হবে নিজেকেই করতে হবে। নিজের চেষ্টায় নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। সেভাবেই শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছেশক্তির প্রবলতায় বিরুদ্ধে পরিবেশ থেকে উঠে এসেছিলেন মেঘনাদ, হয়ে উঠেছিলেন সুবিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী 'মেঘনাদ সাহা'।