অসংখ্য ছদ্মনামের জন্য বিখ্যাত ছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। বহু ভাষাবিদ বলে তাঁর দারুণ সুখ্যাতিও ছিল। এই দুই গুণেই তাঁর সমধর্মী ছিলেন বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়। এই যে তাঁর সর্বজন পরিচিত ‘মানবেন্দ্রনাথ রায়’ নামটি, এটিও আসলে ছদ্মনাম। তাঁর অন্যান্য ছদ্মনামগুলোর মধ্যে মি. মার্টিন, হরি সিং, মি. হোয়াইট, ডি. গার্সিয়া, ডা. মেহমুদ, মি. ব্যানার্জি, ম্যানুয়েল ম্যান্ডিজ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তাঁর আসল অর্থাৎ পিতৃদত্ত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। সেই নাম বদলে তিনি কী করে ‘মানবেন্দ্রনাথ রায়’ নামে পরিচিত হলেন কী করে, সেও এক গল্প।
আসলে নরেন্দ্রনাথ ছিলেন মেদিনীপুরের একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা দীনবন্ধু ছিলেন শ্বশুরবাড়ির আশ্রিত। সামান্য যজমানি আর গ্রাম্য পাঠশালার পণ্ডিতি, এই ছিল তাঁর দিন গুজরানোর সম্বল। তবে নরেন্দ্রনাথ ছিলেন মেধাবী ছাত্র। তাই কষ্ট হলেও দীনবন্ধু তাঁকে শিক্ষাদানের ত্রুটি করেননি। গ্রামের স্কুল পার করে ভর্তি করে দিয়েছিলেন হরনাভির ইংরিজি-সংস্কৃত স্কুলে। এই স্কুল তাঁকে একই সঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বোধে উজাগর করে সচেতন নাগরিক করে তুলল। এরই মাঝে বিবেকানন্দের ‘কর্মযোগ’ পড়ে এবং রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ ভাষণ শুনে পরাধীন স্বদেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার সুপ্ত ইচ্ছে ডানা মেলল। ঠিক করলেন দেশকে ইংরেজের হাত থেকে মুক্ত করার সাধনাই হবে তাঁর সাধনা, তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
সময়টা বিশ শতকের শুরুর দিক। মেদিনীপুরের মাটিতে তখন দিকে দিকে গড়ে উঠছে গুপ্ত বিপ্লবীদের আখড়া। কৈশোরেই চেতনার তরী বেয়ে নরেন্দ্রনাথ তাঁদের সঙ্গে ভিড়ে গেলেন। স্বদেশি ডাকাতিতে। ধরা পড়ে গেলেন। কিন্তু অচিরেই প্রমাণের অভাবে মুক্তিও পেয়ে গেলেন।
সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, আর প্রয়োজন আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের। বাঘা যতীনের নেতৃত্বে ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহ হল। নরেন্দ্রনাথ চার্লস মার্টিন ছদ্মনাম নিয়ে বাটাভিয়া যান অস্ত্র কিনতে। তাঁরই ব্যবস্থাপনায় অস্ত্র আসার আগেই সমস্ত সতর্কতা সত্বেও বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। পুলিশের সঙ্গে বুড়িবালামের সংঘর্ষ হয়। পরিশেষে বাঘা যতীন মারা যান।
তবু দেশের বাইরে থেকে সাহায্য নিয়ে বা অস্ত্র এনে লড়াই চালানোর প্রচেষ্টা নরেন্দ্রনাথ চালাতেই থাকেন। ফিলিপাইন, চিন থেকে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে সানফ্রান্সিসকোতে এসে পৌঁছন। সেখানে পৌঁছেই তাঁর চক্ষুস্থির হবার জোগাড়। কারণ, এত গোপনতা সত্বেও সেখানকার সংবাদপত্রে তাঁর এই আগমনের খবর ফাঁস হয়ে যায়। শুধু তাই নয় খবরে তাঁকে জার্মানির গুপ্তচর হিসেবে সন্দেহও করা হচ্ছে বলে জানা যায়। ফলে বিদেশের মাটিতে গা বাঁচাতে নরেন্দ্রনাথ নিজের প্রকৃত নাম গোপন করে ও বেশ বদলে সেখানে ‘মানবেন্দ্রনাথ রায়’ নামেই পরিচিত হতে শুরু করেন।
মাঝখানে অনেকবার নামবদল করলেও তিনি ‘মানবেন্দ্র’ নামেই পরিচিত হতে পছন্দ করতেন বেশি। এই নামে বিভিন্ন ভাসায় বইও লিখেছেন। ফলে এই নামটিই তাঁর সর্বাধিক পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে স্বাভাবিকভাবেই।
আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করতে করতে তিনি আমেরিকায় র্যাডিকেলদের সংস্পর্শে এসে মার্কসবাদের প্রতি আসক্ত হন। এরপর তাঁর জীবন বৈদেশিক রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে। মেক্সিকোতে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি। রাশিয়ার কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠনের সদস্য হন। বস্তুত এই পর্বগুলিতে তাঁর বিচিত্র কর্মকাণ্ডের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে স্বদেশের স্বার্থের সঙ্গে খুব বেশি যোগ ছিল না। আমরা মানবেন্দ্রনাথকে স্মরণ করি তাঁর কৈশোর ও যৌবনের দুরন্ত বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্য। আমরা স্মরণ করি সেই কিশোর ও যুবককালের মানবেন্দ্রকে, যিনি স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কারাবরণ করেছেন একাধিকবার, মরণপণ বিপ্লব সংঘঠনের চেষ্টা করেছেন বহুবার…