এক ক্ষণজন্মা নক্ষত্রের জীবনযুদ্ধ

পান পাতা মুখ। টানা-টানা চোখ। মেঘের মত একঢাল চুল। ঝকঝকে প্রাণবন্ত চেহারা। শ্রীমান পৃথ্বীরাজ ছবিতে প্রথম পর্দায় এলেন তিনি। অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘অমলার’ ভূমিকায়। ছবিতে উৎপল দত্ত, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়ের মত ডাকসাইটের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। কিন্তু সহজ সরল কিশোরী বধূর চরিত্রে অভিনয় দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই ছবি তার ডেবিউ ফিল্ম। শিপ্রা ওরফে সোনালি রায় ওরফে মহুয়া রায়চৌধুরী। সালটা ১৯৭২।   

FotoJet - 2019-07-22T194518.778

উত্তর কলকাতার চৌধুরী পাড়ায় সেবার গানের জলসা। মঞ্চে বেবি শিপ্রা, ওরফে সোনালি রায়। বয়স তখন বছর চারেক। সেই সময় থেকেই জীবন যুদ্ধের লড়াইতে সামিল হতে হয়েছিল ছটফটে শিশুটিকে। বাবা নীলাঞ্জন রায় চৌধুরী ছিলেন উদয় শঙ্করের গ্রুপের নৃত্য শিল্পী। দমদমে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। তিনি নিজের ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শিশুকন্যা শিপ্রা হয়ে দাঁড়াল তাঁর জীবনের বাজি জেতার তাস।

টালিগঞ্জ পাড়ায় যাতায়াত শুরু করলেন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু কোথাও সুযোগ মিলল না। সব দরজাই যেন বন্ধ। একদিন যেন ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল। সুচিত্রা সেনের মেকআপম্যান জামাল ভাই খবর দিলেন তরুণ মজুমদার তাঁর ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছেন।

এবার আর খালি হাতে ফিরতে হল না। তরুণ মজুমদারের ছবি দিয়েই সত্তর দশকের বাংলা চলচ্চিত্র পেল নতুন নায়িকা। মহুয়াকে।

পরপর বেশ কিছু সিনেমায় পার্শ্ব চিরিত্রে। ১৯৮০ সালে রাতারাতি ঘুরে গেল কেরিয়ারের চাকাটা। যাঁর ছবি দিয়ে সিনেমা জগতে আসা সেই তরুণ মজুমদারের হাত ধরেই। রিলিজ করল ‘দাদার কীর্তি’। ‘সরস্বতী’ মনে গেঁথে গেল দর্শকদের। ৫০ সপ্তাহ চলেছিল।       

FotoJet - 2019-07-22T194548.223

সন্ধ্যা রায় নিজে তাঁর গ্রুমিং-এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অল্প ঘষামাজাতেই হিরের দ্যুতি চোখ ধাঁধিয়ে দিতে শুরু করল। আটপৌরে বাঙালি স্নিগ্ধতার আড়ালে যেন ঝড়ের পাখি। নৃত্যে-বিভঙ্গে-লাস্যে যথার্থ প্রাচ্যসুন্দরী। নাচ থেকে অভিনয় সবেতেই তুখোড় অভিনেত্রী। সাবিত্রী চট্টোপাধায় এবং মাধবী মুখোপাধ্যায়। ‘শিপ্রা’কে গড়েপিঠে ‘মহুয়া’ তৈরি করতে এই দুই অভিনেত্রীও ‘মায়ে’র ভূমিকায়।  

 

 ১৯৭৬- এ তিলক রায়চৌধুরির সঙ্গে বিয়ে হয়। কৈশোরের প্রেম। একটি পুত্র সন্তান-ও হয়। ফুটবল ভালবাসতেন। গোঁড়া ইস্টবেঙ্গল সমর্থক মহুয়া ছেলের নাম রাখলেন ‘গোলা’ তমাল রায়চৌধুরী।

FotoJet - 2019-07-22T194200.149

 রঞ্জিত মল্লিক, দীপঙ্কর দে, সন্তু মুখার্জী, তাপস পাল, চিরঞ্জিত প্রমুখ অভিনেতাদের জুটি বেঁধে  একের পর এক হিট ছবি ছবি। তাপস পালের বিপরীতে সঙ্গে সব চেয়ে বেশিবার নায়িকা হয়েছেন। মিঠুন চক্রবর্তী এবং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধায়ের সঙ্গেও অভিনয় করেছেন।

শোনা যায়, আশির দশকের অভিনেত্রীদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পেতেন তিনি। কিছু ক্ষেত্রে ‘নায়ক’দের চেয়েও বেশি। তাঁর নামে ছবি চলত। হলে দর্শক আসত। ‘হিরো’কেন্দ্রিক সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এ বড় কম কথা নয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৬ প্রায় ৮৫টিরও বেশি ছবিতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।

FotoJet - 2019-07-22T194242.888

তপন সিনহার ‘আদমি অউর অউরাত’ ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৮৭-তে সেই ছবি দামাস্কাসে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যায়। সেরা অভিনেত্রী তিনিই। এই ছবি থেকেই একসময় তাঁকে বাদ পড়তে হচ্ছিল। ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণে। তিনি পরিচালকের কাছ থেকে ১৪ দিন সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। একসময় ছবি থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল অত্যাধিক রোগা হওয়ার কারণে। ‘মোটা’ হওয়ার জন্য ছবি থেকে বাদ পড়তে হবে মানতে পারেন নি। ১৪ দিন পর এসে যখন তপন সিনহার সামনে দাঁড়ালেন চমকে গেলেন ‘আদমি অউর অউরাত’ ছবির পরিচালক।

FotoJet - 2019-07-22T195420.564

এই জেদ তাঁর শেষ দিন অবধি বজায় ছিল।

১৯৮৬ ,১২ জুলাই আগুনের লেলিহান শিখায় ঝলসে গিয়ে ক্যালকাটা হসপিটালের বেডে।  জীবনে ফেরার একলা লড়াই। ডাক্তার,পুলিশ, মিডিয়া। ফ্যান-দের উৎকন্ঠা। এগারো দিন পর এমনই এক শ্রাবণে শরীর ভর্তি দগদগে পোড়ার ক্ষত নিয়ে নিভে যান ।  মৃত্যুর আগে কলকাতা পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছিলেন, ‘ঘটনা শুধুমাত্র দুর্ঘটনা।’ কিন্তু তাঁর মৃত্যু রহস্য আজও ভাবায় বাঙালিকে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...