সারা জীবনটাই হেঁটে ছিলেন পাকদণ্ডী পথে

"স্মৃতি কথা লিখতে গেলে সাংসারিক জীবন আর লেখিকার জীবন আলাদা করা যায় না। দুটো একসঙ্গে জড়িয়ে থাকে। লেখিকামন সংসারের কাজে বাধা ঘটায়। পদে পদে ভুল করায়। যে সব মেয়ে সংসার-গত প্রাণ, তাদের মতো চৌকোস গিন্নি হতে দেয় না।"

নিজের আত্মকথা ‘পাকদণ্ডী’র ২৬৯ নম্বর পাতায় এই কথা লিখেছিলেন তিনি।

সারা জীবনটাই হেঁটে ছিলেন পাকদণ্ডী পথে। সে পথ আগাগোড়াই চড়াই-উৎরাই।কখনও বন্ধুর।

লীলা মজুমদার। রায় বাড়ির মেয়ে। জ্যাঠামশাই উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। বাবা প্রমদারঞ্জন রায়। দাদা সুকুমার।  কিন্তু সেই ঘরও ছেড়েছিলেন হেলায়।

জন্ম সূত্রে ব্রাহ্ম কন্যা। বিয়ে করেছিলেন হিন্দু পাত্রকে। সুধীর কুমার মজুমদারকে।

কোন মতে বিয়ে হবে সে নিয়ে একটা সংকট তৈরি হয়েছিল। সেই জটিলতার  ফলস্বরূপ বাড়িতে বিয়ের কোনও অনুষ্ঠান হয়নি। পরিবারের যারা  ছিলেন তাদেরও প্রমদারঞ্জনের কাছে গোপন করতে হয়েছিল লীলা- সুধীরের বিয়ের আসরে উপস্থিতির কথা। তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। মধ্য ফাগুনের অকাল বৃষ্টিতে হাঁটুজল উপেক্ষা করে আশির্বাণী উপহার দিয়েছিলেন নবদম্পত্তিকে। সঙ্গে কবির নিজের হাতে ডিজাইন করা চামড়ার ব্যাগ।    

 ব্রাহ্ম মতেও নয়, হিন্দু মতেও নয়, বিয়ে হয়েছিল পৌর সভার অ্যাক্টে। নাম সই করে। মালাবদল- আংটিবদলে ২০ মিনিটের মধ্যে বিয়ে শেষ। 

বিয়ের দিনের গল্প বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘... কী করে ভাল স্ত্রী হতে হয় সে নিয়ে দু-চারটি চোখা চোখা কথা বলতে রেজিস্ট্রারমশাই ছাড়েন নি। কে জানে এম-এ পাস করা, কলেজের মাস্টারনী এবং প্রায় পঁচিশ বছর বয়সের মেয়েদের পক্ষে ভাল স্ত্রী হওয়া কি কঠিন ব্যাপার’।

সহজ কথার আড়ালে লেখনীর শ্লেষটুকু পাঠকের গায়ে এসে বেঁধে।

অথচ পাত্র ছিলেন বাবা প্রমদারঞ্জনের চেনা। পছন্দও করতেন তরুণ দাঁতের ডাক্তারটিকে। কিন্তু তবু সময়ের নিরিখে এমন সই-সাবুদের বিয়ে নিয়ে আলোচনা-মন্তব্য কম আসেনি।

কিন্তু সে সবে কান পাতেননি তাঁরা। যেভাবে কান পাতেননি বাড়ির অশান্তিতে। পিতা-পুত্রী দু’জনের প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে ভেসে গিয়েছিল স্নেহের টান। তবে একেবারে হারিয়ে যায়নি।

বলিষ্ঠ বোধের আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ ছিলেন লীলা মজুমদার। প্রবল ঝড়ের মুখে নৌকা যখন টালমাল তখন শক্ত হাতে হাল ধরতে জানতেন। সে ছবি পাওয়া যায় বারবার। বিশেষ করে তাঁর মায়ের মৃত্যুতে।

কার্শিয়াং- এ মৃত্যু হয়েছিল তাঁর মায়ের। খবর আসার পর কলকাতা থেকে দিদি-দাদাদের নিয়ে উড়ে গিয়েছিলেন কার্শিয়াং।

এক ফোঁটা চোখে জল নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ।কান্না তাঁর আসে না। সেই তাঁর শেষ কার্শিয়াং যাওয়া। আর কখনও যাননি। বদলে যাওয়া শহরটাকে আর কখনও দেখা হয়ে ওঠেনি।

লেখাতে ফিরে ফিরে এসেছে পাহাড়। কুয়াশা। মেঘ। ছোটদের কথা লিখতে গিয়ে ফিরে ফিরে এসেছে নিজের ছোটবেলা।    

ভালোবাসতেন ইংরেজি ভাষাটা। লাইব্রেরীতে ইংরেজি সাহিত্যের নতুন বই এলে ছাড়তেন না, কিন্তু তাঁর নিজের লেখার ভাষা ছিল বাংলা। নিজের সম্বন্ধে বলেছিলেন, ইংরেজীতে বিদ্যাদিগগজ হওয়া তাঁর উদ্যেশ্য ছিল না। বাংলার ছোট-ছোট ছেলেদের জন্য লিখতে চান। মনে করতেন সেখানেই তাঁর সত্যিকারের সাফল্য।

লেখিকা মনের সঙ্গে বারবার দ্বন্দ্ব বেঁধেছে সংসারের। চলার পথে। একদিকে কালি, কলম আর স্থিতধী মন আর নিমগ্ন শব্দ সাধনা অন্যদিকে কর্তব্যের কলরব, দুইয়ের মাঝে আতান্তর চলেইছে। সেই দ্বিধা- দ্বন্দ্বকে তিনি অস্বীকার করেন নি।

লিখেছিলেন, দুনিয়ার সব দেশে, সব কালে এই সমস্যা সত্যি। সমান, প্রতিভা, এবং সমান দক্ষতার অধিকারী হয়েও সংসারের বাঁধন মেয়েদের কর্মজগতে পিছিয়ে দিচ্ছে।

তবে লীলা ছিলেন অন্য ধারার মানুষ। নিজের ভাষাতেই তিনি ব্যতিক্রমের দলে। যিনি সারা জীবন পথ হেঁটেছেন নিজের শর্তে।শুধু সাহিত্যিক হিসেবে নয়, নিজের সময়ের থেকে অনেক ক্রোশ এগিয়ে থাকা আধুনিক চেতনায় উজ্জ্বল এক ঋজু মানবী হিসেবেও।

 

    

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...