"যা পাইনি তার জন্য দুঃখ নেই, যা পেয়েছি তা দিয়ে মন ভরে আছে। বিধাতা যতদিন রাখেন, যেন কাজ করে যেতে পারি আর যখন ডাক দেবেন, সব ছেড়ে কলম নামিয়ে যেন চলে যেতে পারি।"নিজের আত্মজীবনী 'পাকদন্ডী'র শেষ পাতায় লিখেছিলেন লীলা মজুমদার।বাস্তবিক অর্থেই যা পাননি তার জন্য প্রবল কোনও দুঃখ বোধ বা আফসোসকে কখনও জায়গা দেননি জীবনে। প্রতিটা অন্ধকারের শেষে আছে এক আলো ঝলমলে দিন। পাহাড়ের কঠিন খাঁজে যেমন ঝর্ণার ঝরঝর শব্দ অনেকটা তেমনি। গোটা জীবনকে দেখেছিলেন এক আশ্চর্য আশাবাদী দৃষ্টিতে।
লীলার জীবন শুরু হয়েছিল শিলং পাহাড়ে। সে এক রূপকথার মতো জীবন। প্রকৃতির নিরাপদ আশ্রয়ে নিশ্চিন্তে বেড়ে ওঠা। বেশ কয়েকবার বাড়ি বদল করতে হয়েছিল। কিন্তু সে যেন অনেকটা এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে যাওয়ার মতো। হারাবার ভয় নেই। নির্ভার। মুক্ত। কিন্তু সেই পাহাড়ী পথই যেন নিয়তি ধার্য হয়ে গিয়েছিল তাঁর জন্য।একদিন পাহাড়ের বাস ছেড়ে নেমে আসতে হল সমতলের মাটিতে। এই কলকাতা শহরে। তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি। ২২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিট। দোতলা , ভাড়া বাড়ি। সেই বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি আঁকা। এঁকেছেন লীলার জ্যাঠামশাই। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তাঁর শিল্পী খেয়ালে গোটা বাড়িটাই একটা আস্ত ক্যানভাস। নানারকম ছবি সাজিয়ে ছোট্ট লীলাকে কাছে ডাকে। রঙ চেনায়। লীলা আচ্ছন্ন হন। ছবি, গান, বেহালা, হারমোনিয়ম সব মিলিয়ে সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ি যেন অন্য পৃথিবী। তাঁর দেখায় রঙ লাগছিল। মনের মধ্যে ছবি জমার অভ্যাসটাও শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, " জন্ম মুহুর্তে কেউ সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি হয়ে মাটিতে পড়ে না। যতদিন বাঁচে, তিলে তিলে তৈরি হয়।"
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু, দেশ ভাগ, দাঙ্গা, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের উত্তাল দিনরাত, মন্বন্তর তিনি দেখেছেন। চোখের সামনে যেন রাতারাতি বদলে গিয়েছে তাঁর ছোটবেলার চেনা দুনিয়াটা। পেলবতা হারিয়ে কর্কশ। কখনও বা কর্কশতর। কিন্তু দেখায় রঙগুলো হারিয়ে যেতে দেননি তিনি। তাঁর কলমে বাঁচিয়ে রেখে গিয়েছেন হারানো পৃথিবীর রূপকথা। যেখানে আজও হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় হলুদ পাখির পালক। দুঃখী বন্ধুর মনে খারাপে সঙ্গ দেয় টংলিং। মন্দ সময়ের ব্যাথা বিলীন হয়ে যায় বুদবুদে। ডানা গুটিয়ে রাখা সুরের পাখি শিস দিতে দিতে উড়ে যায়। নীল পাহাড়ে কাঁচা সোনা রোদ। সাদা অর্কিড আলো হয়ে জেগে।মরা সময়ের অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে আগলে রাখেন লীলা। সুদিন ফিরবেই