১৯২৭ সালে সাইমন কমিশন তৈরি হওয়ার ঘোষণা হয়েছিল। ১৯২৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে সাইমন কমিশনের সদস্যরা ভারতে আসেন। সাইমন কমিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়রা তাঁদের নিজেদের দেশ শাসন করার জন্য কতটা উপযুক্ত তা খতিয়ে দেখা। অথচ সেখানে ছিল না কোন ভারতীয় সদস্য প্রতিনিধি। আসলে ব্রিটিশ সরকার যখন দেখল রাজশক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানো বৈপ্লবিক শক্তিকে কিছুতেই প্রতিহত করা যাচ্ছে না, তখন সাধারণ, নিরীহ ভারতবাসীকে বোকা বানানোর জন্য চক্রান্তের আশ্রয় নিল তাঁরা। তেমনি এক চক্রান্তের নাম সাইমন কমিশন। এই চক্রান্তের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রতিহত করা। কিন্তু ফল হলো উল্টো। দিকে দিকে গর্জে উঠল ভারতবাসী। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জন্ম দিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের। চারিদিকে স্লোগান উঠলো ''সাইমন কমিশন ফিরে যাও''। ব্রিটিশ সরকারের অবস্থা তখন নাজেহাল।
পাঞ্জাবের বড় শহর লাহোরেও যথারীতি আন্দোলন চলছিল সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে। তখন সাইমন কমিশনের সাত সদস্যের দল লাহোরে এসেছেন। লাহোর স্টেশনে বিরাট প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়েছে। নেতৃত্বে এক বৃদ্ধ। মাথায় পাগড়ি। বয়স তাঁর শরীরকে বিধ্বস্ত করতে পারলেও অন্তরের কোটরে বাসা বেঁধে থাকা দেশপ্রেমের এক কনাকেও ছুঁতে পারেনি। এই দেশপ্রেম যেন সেই বৃদ্ধের আজন্মকাল সঙ্গী। তাই শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে হওয়া সমস্ত প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন তিনি। সেদিনও তেমনই দিন ছিল। ১৯২৮ সালের ২৮শে অক্টোবর। লাহোর স্টেশনের শুরু হওয়া সেই প্রতিবাদ মিছিল যত এগোচ্ছিল, পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাথাড়ি লাঠি চালানো শুরু করল। সেই মিছিলে অংশগ্রহণ করার যুবকদের কাছে ওই বৃদ্ধ ছিলেন দেশপ্রেমের অভিভাবক, যারঁ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন অনেকেই। ওই বৃদ্ধকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলো পাঞ্জাবের বিপ্লবী দল নওজোয়ান ভারত সমিতির সদস্য শুকদেব ও ভগবতীচরণ ভোরা। তাঁরা ওই বৃদ্ধের চারিদিকে বেষ্টনী তৈরি করে তাঁকে লাঠির আঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার জানতো বিপ্লবের শিকড়গুলো উপড়ে না ফেলতে পারলে, তাকে সামলানো যাবে না। ব্রিটিশ পুলিশের লাঠিচার্জের নেতৃত্বে ছিলেন পুলিশ সুপার স্কট। তিনি নির্দেশ দিলেন ওই বৃদ্ধকে ঘিরে থাকা বেষ্টনী ভেঙে ফেলতে। বিপুল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলো ডেপুটি পুলিশ সুপার সন্ডার্স। তারপর নির্মমভাবে এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জ করা হলো। গুরুতরভাবে আহত বৃদ্ধের রক্তাক্ত শরীর মাটিতে আছড়ে পড়ল। দেশের মাটিতে মিশে যাচ্ছিল তাঁর সন্তানের রক্ত। পরে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ১৭ই নভেম্বর দেশমাতাকে নিজের প্রাণের অঞ্জলি প্রদান করে বিদায় নেন সেদিনের সেই বৃদ্ধ মানুষটি-লালা লাজপত রাই।
কিছু মানুষ বট গাছের মত হয়। সারা জীবন ধরে ছায়া প্রদান করে যান। তেমনি দেশপ্রেমিক ছিলেন লালা লাজপত রাই। দেশের প্রতি ভালোবাসা ও তাকে স্বাধীন করার জন্য আন্দোলন ছিল তাঁর জীবনের ছায়াসঙ্গী। শুধু নিজেই দেশপ্রেমএর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন নি, অগণিত যুবকের মনে দেশপ্রেমের ভাবনা বীজের মত রোপন করে দিয়েছেন, যা পরবর্তীকালে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ১৮৬৫ সালের ২৮শে জানুয়ারি জন্ম লালা লাজপত রাইয়ের। লাহোরের কলেজে পড়াকালীন তিনি সংস্পর্শে আসেন দয়ানন্দ সরস্বতীর, সেখান থেকেই দেশের প্রতি ভালোবাসা ও তার জন্য বলিদানএর চিন্তাভাবনা গেঁথে বসে তার হৃদয়ে। পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেসের কার্যকলাপে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এই পাঞ্জাব কেশরীর অন্যতম সুযোগ্য শিষ্য ছিল ভগৎ সিং। তাঁর মৃত্যুর প্রতিবাদে ডেপুটি পুলিশ সুপার সন্ডার্সকে হত্যা করেছিলেন ভগৎ সিং ও রাজগুরু। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল লালাজির মৃত্যুর জন্য দায়ী স্কটকে হত্যা করা। কিন্তু সেদিন স্কটএর বদলে সন্ডার্সকে অব্যর্থ গুলির নিশানায় হত্যা করে এই যুবক বিপ্লবীরা। লালাজির আত্ম-বলিদান ব্যর্থ হতে দেয়নি তাঁরই আদর্শে দীক্ষিত দেশমাতার বীর সন্তানেরা।