সোনারঙ্গ। পুববাংলার ঢাকা জেলার গ্রাম। সেই গ্রামে ১৮৮০ সালের ২ ডিসেম্বর জন্ম হল ক্ষিতিমোহনের। জাতিতে বৈদ্য, পদবি তাই 'সেন'। শাস্ত্রবিদের বংশে সকলেই পণ্ডিত। পিতামহ রামমণি শিরোমণি তার ওপর বিখ্যাত কোবরেজ। গ্রামে টোল খুলে অধ্যাপনাও করেন। প্রতিবেশী দশ-বিশটা গাঁয়ে তাঁর খুব নামডাক। কিন্তু, সে-সব ছেড়ে রামমণি সপরিবারে কাশীবাসী হবেন বলে স্থির করে ফেললেন। কারণ, কোষ্ঠী। হ্যাঁ, কোষ্ঠীতে লেখা বাহাত্তর বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হবে। কাশীধামে মৃত্যু হলে মোক্ষ মেলে। হিন্দুদের আজন্ম তাই-ই তো শাস্ত্রীয় বিশ্বাস। সে-কারণেই রামমণির কাশীবাসের সিদ্ধান্ত। বাহাত্তরে পা দিতেই তাঁরা সোনারঙ্গ ছেড়ে জলপথে পাড়ি দিলেন কাশী। বাসা বাঁধলেন এসে বাঙালিটোলার পাতালেশ্বরে। ক্ষিতিমোহন তখন নিতান্তই শিশু।
কাশীতে এসে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। পিতামহের বাহাত্তর পূর্ণ হল তবু মরলেন না, কিন্তু পিতামহী মারা গেলেন দুম করে। পিতামহ যে শুধু বাহাত্তরেই মরলেন না এমন নয়, কোষ্ঠীর লিখন মিথ্যে করে আরও পঁচিশটা বছর বহাল তবিয়তে কাটিয়ে দিলেন। তারই মধ্যে শিশু ক্ষিতিমোহন দাদা-ভাইদের সঙ্গে বড় হতে হতে বালক হয়ে উঠতে লাগলেন।
কাশী সাধুসন্তের ভূমি, প্রাচ্যবিদ্যার দেশ। ফলে, শৈশবেই ক্ষিতিমোহন সাধুসন্তের সান্নিধ্য পেতে লাগলেন খুব। বিখ্যাত সাধক তৈলঙ্গস্বামী, তিনি শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। ভালোবাসার প্রশ্রয়ে ক্ষিতিমোহন কখনো তাঁর কাঁধে-পিঠে চড়ে নানান আবদার করেছেন এ-সময়, কখনো বা তাঁর দেওয়া মিঠাই খেয়ে আহ্লাদিত হয়েছেন। তৈলঙ্গস্বামী ছাড়াও বিশুদ্ধানন্দ, ভাস্করানন্দ ও মাতাজির মতো কাশীর বিখ্যাত সব সাধক-সাধিকার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হল ক্ষিতিমোহনের। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই আধ্যাত্মিকতার পথটিই তাঁর নিজস্ব পথ বলে মনে হতে লাগল। অন্তর খুঁজে পেল আনন্দময় ভাবলোক। অজস্র ধর্মপথের মধ্যে জাতি-বর্ণ-ভেদাভেদের ঊর্ধে সাধক কবীরের পথটিকেই তাঁর শ্রেয় ও শরণযোগ্য বলে মনে হল। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই হল তাঁর এই উপলব্ধি। আর দেরি করলেন না। তৎক্ষণাৎ তিনি এই পথেই দীক্ষা নিলেন।
ক্ষিতিমোহনের মামারা কালাপানি পেরিয়ে বিলেত গিয়েছিলেন পড়তে। সেই অপরাধে গ্রামের চাঁইরা তাঁদের একঘরে করে ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিয়েছিল। মামাবাড়িটি ছিল ক্ষিতিমোহনের গ্রামেই। এপাড়া-ওপাড়া। ফলে, মামাবাড়ির জন্য যে শাস্তি বহাল হল, ক্ষিতিমোহনদের বাড়িটি তার প্রকোপ থেকে রক্ষা পেল না। বিলেতমুখী পশ্চিমী-শিক্ষার জন্য যে পরিবারটির উপর দিয়ে অহেতুক ঝড় বয়ে গেছে, ক্ষিতিমোহনের সেই পরিবারটি কিছুতেই চাইল না যে, ছেলেরা ইংরেজিধারায় পড়ুক। ক্ষিতিমোহনের মনটি অবশ্য সংস্কৃত সাহিত্য-শাস্ত্র-স্মৃতি-ন্যায়-দর্শন-জ্যোতিষ-ব্যাকরণ পড়ার জন্য তৈরি হয়েই ছিল। টোল-চতুষ্পাঠীতে সেই পথ আরও প্রশস্ত হল। আর এ-পথেই কুইন্স কলেজ থেকে 'শাস্ত্রী' উপাধি নিয়ে এমএ পাশ করলেন তিনি।
প্রাচীন কালে শাস্ত্রশিক্ষা ছিল শ্রুতিমূলক, স্মৃতিবহ। সেই রীতিতে উনিশ শতকের টোল-চতুষ্পাঠীতেও ছাত্রদের স্মৃতিশক্তিকে তুখোড় করে তোলার ওপর জোর দেওয়া হত। ফলে, ক্ষিতিমোহনের স্মৃতিশক্তি অসম্ভব রকমের তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল। কুইন্স কলেজের অধ্যক্ষ পেপার তৈরি করে ক্লাসে একবার ভারতীয় দর্শনের ওপর টানা ক'দিন লেকচার দিলেন। কিন্তু, তারপরই লেখাগুলো কীভাবে যেন হারিয়ে ফেললেন। হারানো জিনিসই সর্বদা দেখা যায়, অত্যন্ত দরকারী হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রেও তাই হল। কাজেই তাঁকে ছেলেদের নোটের ওপর ভরসা করে তাদের শরণ নিতে হল। কিন্তু, নোট দেখার দরকারই পড়ল না। সমস্যাটি শুনে একা ক্ষিতিমোহনই সব ক'টি লেকচার আগাগোড়া মুখস্ত বলে দিলেন। ক'দিন পর হারানো লেখা পাওয়া গেল অবশ্য। তখন ক্ষিতিমোহনের স্মৃতি ও মূল লেকচার মিলিয়ে দেখা গেল, দুয়ের মধ্যে দু'এক জায়গা ছাড়া আর কোথাও কোন প্রভেদ নেই!
পড়াশুনো যথেষ্ট হল। হবারই কথা। পাণ্ডিত্য তাঁদের বংশের ধারা। সাধুসঙ্গের নেশা তো ছিলই, এবার তা আরও পেয়ে বসল। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে লাগলেন দিনের পর দিন। ডুব দিতে লাগলেন একাধিক দিনের জন্য। সাধুসন্নিধানে অধ্যাত্ম-দর্শন আর জীবন-দর্শনের পাঠ নিয়ে অন্তরলোক সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠতে লাগল। পিতা-মাতার আশঙ্কা হল, ছেলে বুঝি কেবল সুতো ছিঁড়বার অপেক্ষায়। কাজেই, কাশী থেকে সপুত্র ফিরলেন ফের সোনারঙ্গের মাটিতে। না, কাশীর বাস তুলে দিলেন না; তবে সোনারঙ্গের বাড়িটি সারিয়ে-সুরিয়ে প্রকৃত ভদ্রাসন করে তুললেন। ছেলের বিয়ে দিলেন। সংসারে বিতৃষ্ণ হয়ে সন্ন্যাসের পথ ক্ষিতিমোহনের কখনোই ছিল না। মানুষের মধ্যে মানুষকে আর সাধকের চোখ দিয়ে মনুষ্যত্বকে চিনে নেওয়ার নেশায় তিনি ছিলেন গভীরভাবে মগ্ন। আর ছুঁতে চাইছিলেন পরমার্থের অতলস্পর্শ রহস্য। এ-পথে তিনি ছিলেন ভাবের মানুষ। বিয়ের পরও তাই রইলেন। তাই বলে, কর্তব্যকে অবহেলাও করলেন না। অধ্যাপনার কাজ জোটানোর জন্য চেষ্টাচরিত্তির করতে লাগলেন।
হিন্দি, সংস্কৃত আর ফার্সিতে ক্ষিতিমোহনের শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হয়েছে। তাই বলে বাংলা যে একেবারেই জানতেন না, তা না। মায়ের কাছে বর্ণপরিচয় হয়েছে এবং বিদ্যের দৌড় এগিয়েছে বটতলার কাশীবাসী-কৃত্তিবাসী অব্দি। তাঁর যখন যৌবনকাল, তখন এদিকে বঙ্গদেশে রবীন্দ্রনাথ নতুনত্বের ছোঁয়ায় একবারে মাতিয়ে ফেলেছেন বঙ্গসাহিত্যের আসর। কিন্তু, তখনও তাঁর নাম কাশীতে ক্ষিতিমোহনের কান অব্দি পৌঁছয়নি। যজ্ঞেশ্বর তেলীর বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠে 'সখী আমারি দুয়ারে কেন আসিল' প্রভৃতি গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন, কিন্তু সে-গান যে রবীন্দ্রনাথের লেখা তা তাঁর পক্ষে তখনও জানা সম্ভব হয়নি। রবীন্দ্রনাথের নাম প্রথম শুনলেন বিপিন দাশগুপ্ত নামের এক যুবকের কাছে, কাশীর গঙ্গার ঘাটে। শুনলেন কবিতাও। মনে হল, এ যেন উপনিষদ, বাউলের গান ও সন্তবাণীর ত্রিবেণীসঙ্গম। অমনি সেই কবির 'কড়ি ও কোমল' ও 'বিসর্জন' হয়ে উঠল তাঁর অন্তরের ধন। ইচ্ছে হল কবিকে দেখার। শুনলেন মিনার্ভা থিয়েটারে কবি তাঁর 'স্বদেশী সমাজ' প্রবন্ধ পড়ে শোনাবেন। আগ্রহের আতিশয্যে গেলেন আধঘন্টা আগে। গিয়ে অবাক, হল ও হলের বাইরে লোকে লোকারণ্য! ভিড়ের ঠেলায় ঢুকতেই পারলেন না। দোরে এসে ফিরে যাবেন! কবিকে দেখা হবে না! এই ভাবনার বশে শেষমেশ মরিয়া চেষ্টা করতে গিয়ে টানাটানিতে জামাটাই ছিঁড়ে গেল তাঁর! তারপর অবশ্য দেখা হল একদিন। বাংলা ১৩১১ সনের ১৩ই শ্রাবণ কবিকে প্রথম দেখতে পেলেন, কাছ থেকে, কার্জন থিয়েটারে ওই একই প্রবন্ধ পাঠকালে। তারপর আরও দু'একবার কবির সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু, সংকোচের বিহ্বলতায় আলাপ হল না।
দিন কাটতে লাগল। ইতোমধ্যে ক্ষিতিমোহন গ্রামের পাঠশালায় বিনিবেতনে বছর তিনেক পড়িয়ে ফেলেছেন, বিধানচন্দ্র রায়ের সহপাঠী হয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজে কিছুদিন ডাক্তারি পড়ে ছেড়েও দিয়েছেন। সোনারঙ্গে এরইমধ্যে একদিন এলেন কালীমোহন ঘোষ নামের এক স্বদেশি-সংগঠক। ক্ষিতিমোহনকে রবীন্দ্রভক্ত ও পল্লীউন্নয়নের কাজে সক্রিয় জেনে একেবারে সঙ্গী করে ফেললেন তিনি। গড়ে উঠল সৌহার্দ্য-সম্পর্ক। সঙ্গ করে কালীমোহন পরিচয় পেলেন ক্ষিতিমোহনের লোকপ্রেমিক মনটির এবং মনের গভীরের সমৃদ্ধ ভাবলোকটির।
ওদিকে রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর শান্তিনিকেতনের আশ্রম-বিদ্যালয়টির জন্য একজন সাহিত্যপ্রেমী, বিদ্বান ও 'লোকপ্রেমিক' লোক হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন। কালীমোহন তাঁরও পরিচিত। তা, কালীমোহন পুববাংলা থেকে ফিরে রবীন্দ্রনাথ যেমনটি চাইছেন, তেমনই লোক, ক্ষিতিমোহনের খোঁজ দিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ হাতে যেন চাঁদ পেলেন। আর দেরি করলেন না, ডাক দিলেন ক্ষিতিমোহনকে। ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। ক্ষিতিমোহন তখন চাম্বায়, শিক্ষক হয়ে চাকরি করতে গেছেন। মোটা মাইনে, উন্নতির আশা, বিপুল ঋণভার, বাড়ির দায়িত্ব--এ সবের টানাপোড়েনের মাঝখানে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব পেরিয়ে আশ্রম-বিদ্যালয়ের অনিশ্চিত পথে প্রিয় রবীন্দ্রনাথের ডাকে সাড়া দিয়ে শান্তিনিকেতনে পৌঁছতে ক্ষিতিমোহনের লেগে গেল ছ'সাত মাস।
১৯০৮ সালের আষাঢ় মাসে ক্ষিতিমোহন শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা রাখলেন। কিন্তু, শান্তিনিকেতনে পা রাখার আগেই বুঝেছিলেন এখানে কৃচ্ছ্রসাধনার অনেক পথ যেমন পড়ে আছে; তেমনি পা দিয়ে বুঝলেন, তাঁর কাশীতীর্থের মতোই এই রবীন্দ্রতীর্থেও মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলিয়ে দেবার, জাতি-বর্ণ-ধর্মের ঊর্ধে মনুষ্যত্বকে বিকশিত করার মহান সাধনা চলছে। সাধক রবীন্দ্রনাথ নিজগুণে তাঁকে খুঁজে নিয়ে সেই সাধনার শরিক করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সাধনা এখন তাঁরও সাধনা। এখান থেকেই শুরু হল শান্তিনিকেতনে তাঁর কর্মকেতন ওড়ানোর দিন, যে কেতন তাঁকে প্রজ্ঞায়-পাণ্ডিত্যে-মনুষ্যত্বের পরাকাষ্ঠায় স্মরণীয় করে রাখবে উত্তরকালের কাছে বহুকাল...