কিশোরীচাঁদ মিত্র: উনিশ শতকের অন্যতম মনীষা

উনিশ শতকে জনগণের হিতের জন্য বহু মনীষী বহু বিদ্বান, বহু সাহিত্যিক আত্মনিয়োগ করেছিলেন; কিশোরীচাঁদ মিত্র তাঁদেরই মধ্যে অন্যতম। তাঁর সম্পাদিত 'ইন্ডিয়ান ফিল্ড' পত্রিকা ইংরেজি ভাষায় ইংরেজের অত্যাচারের দলিল হয়ে উঠতে পেরেছিল, জনগণের জবানবন্দি হয়ে উঠতে পেরেছিল। প্রজাদের ওপর জমিদারের অত্যাচার, কৃষকের ওপর নীলকরের অত্যাচারের কথা এই পত্রিকা নির্ভীকভাবে দিনের পর দিন তুলে ধরেছে।

'ইন্ডিয়ান ফিল্ড'-এর জন্য কিশোরীচাঁদ নিজে যেমন কলম ধরেছিলেন, তেমনি এর পাতায় ইংরেজের হাত দিয়ে ইংরেজের অত্যাচারের কাহিনি লিখিয়ে নেওয়ার কৃতিত্বও তার রয়েছে। একদা বাংলার ছোটখাট ও পরবর্তীকালে বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাসলি ইডেন ধারাবাহিকভাবে এই পত্রিকায় নীলবিপ্লবের ওপর প্রবন্ধ লিখতেন।  তাঁকে দিয়ে এভাবে লিখিয়ে নেওয়া, এ-বড় কম কথা নয়। কিশোরীচাঁদ নিজে এই পত্রিকায় 'দ্য রায়ত এন্ড জমিনদার', 'এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া', 'মফ:স্বল পুলিশ', 'অবজারভেশনস অন দা রেন্ট ল', 'অবজারভেশনস অন দা নিয়ে সেল ল' প্রভৃতি বিষয়ে প্রবন্ধে প্রশাসকের শোষণ, দেউলেপনা ও জনস্বার্থহীনতা অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ ও যুক্তিনিষ্ঠভাবে তুলে ধরতেন। সেই জন্য সমসাময়িক আর-এক দেশহিতৈষী কৃষ্ণদাস পাল তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন: 'বাবু কিশোরীচাঁদ মিত্র একজন দেশপক্ষসমর্থক ছিলেন। সংবাদপত্রের স্তম্ভেই হোক কিম্বা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সভাগৃহেই হউক কিম্বা টাউনহলেই হউক তিনি কোন বিষয়ে বলিতে সংকুচিত হইতেন না, তাঁহার অভিমত এবং উপদেশ ক্ষমতাশালী ব্যক্তিগণের সন্তোষজনক হউক বা না হউক।' শাসকের বিরুদ্ধে সত্য কথা নির্ভয়ে বলতে যুগে যুগে প্রয়োজন হয় নিষ্ঠার, হিম্মতের; কিশোরীচাঁদের মধ্যে সেই দুটোই বহাল তবিয়তেই ছিল।

আবার, পরহিতচিন্তাও কিশোরীচাঁদের মধ্যে ছিল সদাজাগ্রত। বিলেত থেকে দেশে ফিরে মধুসূদন দত্ত যখন অর্থের আশায় কর্মের আশায় নিদারুণ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন, তখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কিশোরীচাঁদ। তাঁকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মধুসূদনকে পুলিশকোর্টে ইন্টারপ্ৰিটারের চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিলেন। বাংলাভাষায় সাহিত্য রচনায় উৎসাহিত করেছিলেন। বঙ্কিমের সাহিত্যসূচনাতেও কিশোরীচাঁদের অবদান রয়েছে।  বঙ্কিম তাঁর প্রথম উপন্যাস 'রাজমোহন'স ওয়াইফ' ইংরেজিতে লিখেছিলেন এবং তা প্রকাশিত হয়েছিল কিশোরীচাঁদের 'ইন্ডিয়ান ফিল্ড' পত্রিকায়।

কর্মজীবনে কিশোরীচাঁদ ছিলেন ইংরেজের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। দেশের প্রশ্নে দশের প্রশ্নে সেই ইংরেজের বিরোধিতা যখনই প্রয়োজন হয়েছে, তিনি মাথা উঁচু করে করেছেন। রাজশাহীতে কর্মকালে এই অঞ্চলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসালয় স্থাপন, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার প্রভৃতিতে প্রভূত ভূমিকা গ্রহণ করেন। কলকাতায় ফিরে বিধবাবিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের সহযোদ্ধা হন। তবে কিশোরীচাঁদের সবচেয়ে বড় কাজ হল, দেশীয় ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ইংরেজের বিচারের স্বপক্ষে আন্দোলন। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তাতে ইংরেজের রোষে পড়ে কর্মচ্যুতি ঘটেছিল তাঁর। স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তিনি এভাবেই সেদিন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অধিকার আদায়ের সোপান।

আসলে, কিশোরীচাঁদের মতো মানুষেরা ছিলেন বলেই সেদিন বাঙালির গৌরব অভ্রভেদী চূড়া স্পর্শ করতে পেরেছিল। স্বাধীনতার লড়াই, অধিকারের লড়াই, চেতনা জাগরণের আন্দোলন সব ক্ষেত্রেই ভারতবর্ষের বুকে বাঙালি হয়ে উঠেছিল পথ-প্রদর্শক; তাঁদের জন্যই উনিশ শতক হয়ে উঠেছিল পথ দেখানোর শতক...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...