তাঁর নাম, ‘খালেদ চৌধুরী’। এই নাম তাঁকে অন্য কেউ দেয়নি, এই নাম তিনি নিজেই নিজেকে দিয়েছিলেন। কীভাবে? সেও আসলে এক ইতিহাস।
তাঁর জন্ম হয়েছিল মামার বাড়িতে। আসামের করিমগঞ্জের দাসগ্রামে। মা হেমনলিনীর মামা ছিলেন শ্রদ্ধেয় গুরুসদয় দত্ত। তিনিই প্রথম খালেদের নাম রেখেছিলেন ‘চিরকুমার’। পরে সেই নামে আবার কারুকাজ করলেন বাবা। তাতে নামে খানিক পরিবর্তন ঘটল। সেই পরিবর্তনের জোয়ারে ‘তিনি’ হয়ে উঠলেন, ‘চিররঞ্জন’। পাকেচক্রে দু’জনেই তাঁর নামে ‘চির’কে প্রাধান্য দিলেন বটে, কিন্তু চিরকাল সংসারে ধরে রাখতে পারলেন না। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, খালেদের মা মারা গিয়েছিলেন অল্পবয়সে। সংসারে সৎ-মা আগে থেকেই ছিলেন। তিনি সাহস করে খালেদকে বুকে টেনে নিতে পারেননি। কাজেই দিনকে-দিন খালেদ ছন্নছাড়া হয়ে উঠতে লাগলেন। বাবা তা দেখে গা করলেন না। ফলে, সংসারের টান আলগা হতে হতে একেবারেই ছিঁড়ে গেল। বেরিয়ে পড়লেন পথে।
পথ তাঁকে ছেঁড়া ছেঁড়া আশ্রয় দিল, তাঁর উদারতায় শান দিল, প্রসার-উন্মুখ মনোভূমিতে কৃষ্টি হল। আখড়ায় আখড়ায় ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন লোকবাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে আলাপ হল, বাজাতেও শিখে গেলেন। লোকগানের সঙ্গে পরিচয় হল। তৈরি কানে ধরে নিলেন তার সুরবৈচিত্র্য। করে নিলেন অন্তরের সম্পদ। ফকির-মৌলবি-সূফীসাধকদের সাধনপথ তাঁর ভালো লাগল। তাঁদের গানের দর্শন তাঁর অন্তরে জায়গা পেল। ক্রমে তাঁর ঠাঁই হল এক মুসলিম পরিবারে। ভালো লাগল সেই পরিবারের আন্তরিকতা। যে-আন্তরিকতা তিনি মা মারা যাওয়ার পর বাড়িতে আর পাননি। তাই গৃহের সেই অবজ্ঞা ভুলতে এবং নতুন এই আত্মীয়দের আত্মীয়তা স্মরণে রাখতে নিজেকে দিলেন মুসলিম নাম। ‘খালেদ’। ‘খালেদ’ শব্দের অর্থ, ‘চিরস্থায়ী’। মায়ের মামা ও বাবার ‘চির’ শব্দের দুর্বলতাকে বাতিল করলেন না, তাকেও রাখলেন নামের অন্তরে। তবে পিতৃসূত্রে পাওয়া পদবি ‘দত্তচৌধুরী’র অর্ধাংশ রাখলেন, বাকি অর্ধেক বাতিল করলেন। হয়ে উঠলেন, ‘খালেদ চৌধুরী’।
খালেদ ছিলেন এক অভূতপূর্ব গুণপনার সমন্বয়। তিনি স্বশিক্ষিত শিল্পী। আঁকতে আঁকতে আঁকিয়ে হয়েছিলেন তিনি; গাইতে বাজাতে শিল্পী। প্রচ্ছদশিল্পকে জীবিকা করেছিলেন। সারা জীবনে এঁকেছেন কয়েক হাজার প্রচ্ছদ। আসলে, যে কাজই তিনি করেছেন, তা গতানুগতিকতার বাইরেই করার চেষ্টা করেছেন। প্রথম প্রচ্ছদ আঁকাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালে। যাত্রা শুরু হয় চিন্মোহন সেহানবিশের অনুবাদে ডাইসন কার্টারের ‘সোভিয়েত বিজ্ঞান’ বইটির মধ্য দিয়ে। এই বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে তাঁর রোজগার হয়েছিল মাত্র দশ টাকা। তবু এঁকে প্রথম রোজগার করতে পেরে ভারি উৎসাহ এসেছিল তাঁর মনে। মনে হয়েছিল, এই-ই ঢের! ছুটতে শুরু করেছিল স্বাবলম্বীতার ঘোড়া। অবশ্য এর আগেই তাঁর যোগাযোগ ঘটে গিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। এবং ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সক্রিয় সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়া হয়ে গিয়েছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখের সঙ্গে গানের স্কোয়াডে।
এই স্কোয়াডের হয়েই গত শতকের চারের দশকের শুরুতে তিনি বন্যা ও দুর্ভিক্ষে ত্রাণ সংগ্রহ করেছেন গান গেয়ে। ভ্রমণ করেছেন বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে জনপদে জনপদে; পরিচিত হয়েছেন বাংলার বৈচিত্র্যময় লোকসংস্কৃতি তথা লোকগানের সঙ্গে। তাদের সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন। মূলত এই সময় থেকেই লোকগান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ তাঁর জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। সেই কাজের জন্য পরবর্তীকালে নিজের হাতে গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠান। ‘ফোক মিউজিক অ্যান্ড ফোকলোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট’।
যাই হোক, চারের দশকের শেষদিকে শিল্পীর অধিকারের সংঘাতে বিচ্ছেদ ঘটে যায় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। কিন্তু কমিউনিস্ট-আদর্শের ধারা বয়ে চলে অন্তর বেয়ে কর্মে। শম্ভু মিত্র ও মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে জন্ম হয় নাট্যদল ‘বহুরূপী’র। জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় খালেদকে সেখানে নিয়ে আসেন শম্ভু। কেন নিয়ে এসেছিলেন, সেই সম্পর্কে শম্ভু মিত্র নিজেই বলেছেন, ‘…ওর মতো আমি আর কাউকে দেখিনি। মানে অত অদ্ভুত বুদ্ধি না!...কোনও জিনিস এত দ্রুত এত সামান্য ব্যাপারে করে দিতে পারে। ঝট করে—মানে, জিনিয়াস বলে মনে হয়। রিমার্কেবল—রিমার্কেবল…।’
‘জিনিয়াস’ এই মানুষটিকে দর্শক চিনতে পারেন বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনার সময়ই। আসলে খালেদ ছিলেন বলেই শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিলেন। খালেদ ছিলেন বলেই এই নাটকে শম্ভু মিত্রের ভাবনা বাস্তবায়িত হতে পেরেছিল। রবীন্দ্রনাথ ‘রক্তকরবী’ লিখেছিলেন পাঠের জন্য, মঞ্চস্থ করার জন্য নয়। রামকিংকর বেইজের নেতৃত্বে কবির জীবদ্দশায় এ-নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল বটে, কিন্তু তা মনে দাগ কাটতে সমর্থ হয়নি।
‘বহুরূপী’তে খালেদ শম্ভুর সঙ্গে সমগ্র প্রযোজনাটি অনন্য করে তুলতে মঞ্চ-পরিকল্পনা, পোশাক-পরিকল্পনা, সঙ্গীত ও আবহের দায়িত্ব নিজের হাতে নিলেন। মঞ্চ-সজ্জায় তিনি ‘রক্তকরবী’ প্রচ্ছদে আঁকা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি থেকে রাজার ঘরের সামনের ‘জাল’-এর আইডিয়া নিয়ে তাতে মকরের স-দাঁত হাঁ-মুখ ও উড়ন্ত বাজপাখির রিলিফ যুক্ত করে শোষক ও শোষিতের অসাধারণ এক দ্বান্দ্বিক ব্যঞ্জনা তৈরি করলেন। আর আবহে ও সঙ্গীতে আপন উদ্ভাবনী ক্ষমতার মধ্য দিয়ে যে অভিঘাত তিনি তৈরি করলেন, তা ইতিহাস হয়ে রইল। ‘প্রসঙ্গ নাট্য’ গ্রন্থে তার পরিচয় রয়েছে শম্ভু মিত্রের জবানিতেইঃ
‘নাট্যের শুরু হয় একা নন্দিনীকে নিয়ে। সে মঞ্চের ওপর একটা চবুতরায় বসে ফুলের মালা গাঁথছে। এইখানে এমন একটা কিছুর দরকার হলো যাতে নাটকের একটা মানে প্রকাশ পায়। কল্পনা করা হলো যে এই যক্ষপুরীতে সুরকে খন্ডিত করে বেসুরের প্রতাপ। খালেদ চৌধুরী টিউনিং ফর্ক নিয়ে বেরুলেন পুরনো লোহালক্কড়ের দোকানে খোঁজ করতে। যোগাড় করলেন গোটাকতক ভাঙ্গা লোহার পাত। যেগুলো আলাদা পর্দায় বাজবে। সেই বাজানোর ছন্দে মাঝে মাঝে নাকাড়ার উপর ঝাঁটা মেরে,—কাঠের ওপর ঘা-মেরে একসঙ্গে একটা যন্ত্রের আওয়াজ তৈরি হলো। তারপর সেই বাজনাটা মেলানো হল বাঁশির সঙ্গে। বাঁশির আওয়াজগুলো যেন ব্যবহৃত জীবনের উৎসারিত সুরের মতো, আর অপর আওয়াজগুলো যেন যান্ত্রিক জীবনের বেসুরত্ব। সে কেবলি বাঁশির আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠতে চায়।…এই রকম উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় শ্রীখালেদ চৌধুরী রক্তকরবীর পরতে পরতে দিয়েছেন।’
শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্রের সুর টেনে বলা যায়, শুধু ‘রক্তকরবী’ই নয়, ‘পুতুলখেলা’, ‘গুড়িয়া ঘর’, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘শুতুর মুর্গ’, ‘ডাকঘর’, ‘আকরিক’, ‘তখন বিকেল’, চিলেকোঠার সেপাই’, ‘দেবতার গ্রাস’ প্রভৃতি নাটকের মধ্যেও তাঁর উদ্ভাবনী প্রতিভায় মঞ্চভাবনা, সঙ্গীতে, আবহে ও পোশাক-পরিকল্পনায় তিনি নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন বারে বারে।
খালেদের সেই ‘নিজস্বতা’ ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনা ও তার প্রয়োগ দর্শককে দিয়েছে একই অঙ্গে শিল্পের বহুধা স্বরূপ আবিষ্কারের অনাবিল এক আনন্দ। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারকে শিল্পের পরিধি ও বৃত্তের বাইরের বৃত্তটি দেখাতে দেখাতে এই শিল্পী বারে বারেই যেন গ্রহণ করেছেন প্রণম্য এক স্থপতির ভূমিকা; যে ভূমিকা চিরকাল আমাদের অবিরাম প্রেরণা দিয়ে যায় দিগন্ত পেরিয়ে দিগন্ত নির্মাণের…