রণাঙ্গনে ক্লান্তিহীন দুখু মিঞা

রবীন্দ্রনাথের পর প্ৰথম মৌলিক কবি কে?

বুদ্ধদেব বসুর মতে- নজরুল ইসলাম।

তিনি যখন বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতে নাও বাইতে শুরু করেন তখন রবীন্দ্রনাথ মধ্য গগণে। তবু সেই প্রভাবের একেবারে বাইরে গিয়ে একেবারে নিজস্ব ধরন তৈরি করতে পেরেছিলেন। নজরুল মানে যেন এক প্ৰচন্ড ধাক্কা। প্রচলিত বেড়িগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া। দুর্বার স্পর্ধা। তেজি ঘোড়ার মতো হৈ- হৈ রবে বিদ্রোহ।

নজরুল ডাকবুকো এক মানুষ। খামখেয়ালি ঝড়ের বেগে চলেছেন আজীবন। কখনও হাতে সৈনিকের গোলা বারুদ। কখনও বা কবির কলম। তবে হাতে যখন কলম তুলে নিয়েছেন তখনও শব্দে অক্ষরে বারুদ ভরে দিয়েছেন। অথচ স্কুলের গন্ডির প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। অপরিসীম দারিদ্র্য আর শুরু থেকেই রুক্ষ জীবন সেই সুযোগ তাকে দেয়নি। বিপরীত স্রোতে ভেসে চলা সেই থেকেই।

কিশোর বয়সে পিতৃহারা। মক্তবের পড়া শেষ করতে করতেই লেটোর দলে যোগ দিলেন। মুখে মুখে গান হত সেখানে। বছর দশেক বয়স তখন। তারপর থেকে অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্কুলে যেমন সুযোগ মিলেছে সেভাবেই পড়াশোনা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কাজও চলেছে সেভাবেই। কখনও বেকারীতে। কখনও বাবুর্চি। মেধাবী ছাত্র হিসেবে বৃত্তিও পেয়েছিলেন অষ্টম শ্রেণিতে। রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলের ছাত্র। থাকতেন মহামেডান বোর্ডিং- এ। তারপর একেবারে ডাবল প্রমোশন। সরাসরি দশম শ্রেণিতে।

এই সময়েই সংস্পর্শে এলেন মাস্টারমশাই নিবারণচন্দ্র ঘটকের। তাঁর সাহচর্য কিশোর ছেলেটির মন বদলে দিল। গনগনে আবেগে বিপ্লব এর আগুন। সলতে পাকানোর কাজটি করলেন প্রিয় মাস্টারমশাই। বছর পনেরোর নজরুল তাঁর বড় নেওটা।

৮ জানুয়ারি। ১৯১৭। গ্রেফতার হলেন বিপ্লবী নিবারণ চন্দ্র ঘটক। তিনি বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির ছায়াসঙ্গী ছিলেন। বিচারে পাঁচ বছরের করা দন্ড।

মাস্টার মশাইকে খুব ভালো বাসতেন দশম শ্রেণির ছাত্র নজরুল। দাম দিতে হল ভালোবাসার। ‘বিপ্লবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা’র কারণে কেড়ে নেওয়া হল স্কুলের সেরা ছাত্রের মাসিক বৃত্তি। ব্রিটিশ পুলিশের চাপে পড়ে বাধ্য হল স্কুল কর্তৃপক্ষ। তবে অপরাধ প্রমাণ হল না। পাঁচ মাস পর সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হল। ফের চালু হল ছাত্র বৃত্তি।

কিন্তু তত দিনে বিপ্লবের স্বপ্ন ডালপালা মেলেছে হৃদয়ে। তাকে সামলাবার দায় নেই। প্রি- টেস্টের পর এক আগস্টে নিজেই নাম লিখিয়ে এলেন। একদিন ডাক এল। হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা হয়ে গেলেন করাচির উদ্দেশ্যে। ৬ মাসের সেনা শিবির। ট্রেনিং চলবে সেখানে। তিনি ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট। শুরু হল ১৮ বছরের বাড়ি পালানো এক দামাল ছেলের দুঃসাহসিক অভিযান।

যার নিয়তি লেখা হয়েছিল বিষের বাঁশির সুরে। আজীবন অশান্ত। লেখনীর ছত্রে ছত্রে, শান দেওয়া কথায়, ব্যঙ্গে বিদ্রূপে দেশের মানুষকে জাগানোই হবে যার এক মাত্র কাজ। সংগ্রামের রণাঙ্গনে ক্লান্তিহীন দুখু মিঞা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...