"সাধক হিসেবে অভিনয়-কর্মকে নিয়েছিলেন বলেই সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করেছেন এবং অসাধারণ দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষের জীবন।’' - তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
গত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত মঞ্চে, চলচ্চিত্রে এমনকী বেতার-নাটকেও দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। ডাক পেয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে, তাঁর ছবিতে অভিনয় করবার জন্য। তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস। বাংলা চলচ্চিত্র যতদিন থাকবে, তার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করবে সেই কালজয়ী ছবির নাম। সেই ছবি... একটি নয়, সেই পৃথিবী বিখ্যাত দুটি ছবির নাম "পথের পাঁচালী" এবং "অপরাজিত"। করেছিলেন অপুর বাবা হরিহর-এর ভূমিকায় অভিনয়। তিনি....অপ্রতিম অভিনেতা কানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
সময়টা গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। সত্যজিৎ রায় তখন পথের পাঁচালী ছবির বিভিন্ন চরিত্রর জন্য অভিনেতা খুঁজছেন। কানু বাবু সেইসময় পেশাদার মঞ্চাভিনেতা। বহু নাটকে অভিনয় তো করেইছেন তার সাথে একশোর বেশি ছবিতে অভিনয় করা হয়ে গেছে তখনই। সত্যজিৎ রায়ের তাঁকে পছন্দ হলো। ঠিক করলেন কানুবাবুকে দিয়েই "হরিহর" চরিত্রে অভিনয় করাবেন। তাঁর লেখা "অপুর পাঁচালি" বইতে সত্যজিৎ রায় লিখেছেন, "বাবার ভূমিকায় আমরা কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নেব বলে মনস্থ করি। ইনি পেশাদার অভিনেতা। ...হরিহরের চরিত্রে এঁকে চমৎকার মানাবে।'’....
কানুবাবুও রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু শ্যুটিং শুরুর দিনই বাঁধল গোলযোগ। সুন্দর পরিপাটি করে চুল ছেঁটে কানু বন্দ্যোপাধ্যায় সেটে এসেছেন। সত্যজিৎ রায় রেগে গিয়ে শ্যুটিং বন্ধ করে দিলেন। বললেন "যতদিন না চুল বড় হয়ে হরিহর চরিত্রের মানানসই হবে ততদিন শ্যুটিং বন্ধ থাকবে"...
কিন্তু এই ঘটনায় এতটুকুও ক্ষুব্ধ হননি কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বরং অন্যান্যদের বলেছিলেন যে "এই এতদিনে আমি এক জাত-পরিচালকের দেখা পেয়েছি, যিনি নিখুঁত চরিত্রায়ণের জন্যে সব কিছু করতে পারেন!"...
অসাধারণ অভিনয় করতেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। আসল নাম যদিও ছিল কানাইলাল কিন্তু অভিনয় জগতের মানুষদের মুখে মুখে সেটা "কানু" হয়ে গিয়েছিল। বহু নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি পুরুষ চরিত্রেও অভিনয় করেছেন অসংখ্য নাটকে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৮ অবধি ছিলেন শিশির কুমার ভাদুড়ির পেশাদারি থিয়েটারের দলে।
জীবনের সর্বোত্তম আশির্বাদটিও পেয়েছিলেন অভিনয়ের জন্যই। ১৯৩৬ সাল। সেইসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের নাট্যরূপে অভিনয় করছেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বছরেই ২৪শে জুন সেই নাটক দেখতে এলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। নাটকে ‘নবীনকৃষ্ণ’-র ভূমিকায় কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ইচ্ছে প্রকাশ করলেন এই অভিনেতার সঙ্গে দেখা করবার। তাঁর ইচ্ছানুসারে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন কানুবাবু। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘'আমি যে চরিত্র মনে করে লিখেছি, এ যেন তাই।’'....
প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় ১৯২৭ সালে। প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে। সেইসময় স্বদেশি আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা বাংলা। কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও যোগ দিলেন সেই সংগ্ৰামে। প্রথম ছবিতে অভিনয় থেকে উপার্জিত অর্থ তুলে দিয়েছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীর হাতে।
শুধু বিরাট মাপের অভিনেতাই নন, অভিনয়ের একজন দক্ষ শিক্ষকও ছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, গীতা মতো দিকপাল অভিনেতারা তাঁর কাছে অভিনয়ের পাঠ নিয়েছেন। এমনকি মহানায়ক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে অভিনয়ের খুঁটিনাটি শিখতে আসতেন। এতটাই খ্যাতিমান অভিনয়-শিক্ষক ছিলেন তিনি।
মহান এই অভিনেতা প্রয়াত হন ১৯৮৩ সালে, আটাত্তর বছর বয়সে। কিন্তু শিল্পীদের কখনো কি মৃত্যু হয়? তিনি তাঁর অভিনয়ের মধ্যেই অমর হয়ে থাকবেন।