বাবা বলেছিলেন, মনে রাখবে 'My life has a mission'. মেয়ে মনে রেখেছিলেন। সারাজীবন সে-কথা ভোলেননি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই 'বাবা' ও 'মেয়ে' আসলে কে? বলছি। 'বাবা' হলেন উনিশ শতকের বিখ্যাত মুন্সেফ ও সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিক চণ্ডীচরণ সেন। অদূর-অতীত অবলম্বনে যাঁর লেখা 'মহারাজ নন্দকুমার', 'দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ'-র মতো ঐতিহাসিক উপন্যাস এবং 'আঙ্কল টমস কেবিন'-এর অনুবাদ 'টমকাকার কুটীর' বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। বাঙালির স্বদেশ-চেতনায় নাড়া দিয়েছিল। আর 'মেয়ে' হলেন, রবীন্দ্রসমসাময়িক যুগের বিখ্যাত কবি কামিনী সেন। বিয়ের পর 'সেন' কামিনী অবশ্য আমাদের সুপরিচিত 'রায়' পদবীতে পরিবর্তিত হয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মেয়েকে কোন 'Mission'-এর দিকে বাবা এগিয়ে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, বাবার মতো বাবা পেয়েছিলেন বটে কামিনী। মেধাবিনী কামিনী বরাবর ফার্স্ট হন। তবু তার মধ্যেই আট বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লিখে ফেললেন। কিন্তু, সেই কবিতা পড়েও আর পাঁচজন বাবার মতো মেধাবিনী মেয়ের মাথা থেকে কবিতার ভুত নামানোর জন্য চণ্ডীচরণ মোটেই উগ্র বা ব্যগ্র হলেন না। উল্টে মেয়েকে উৎসাহ দিতে কাশীদাসের 'মহাভারত' ও কৃত্তিবাসের 'রামায়ণ' কিনে দিলেন। এমনকি চাকরিসূত্রে মেদিনীপুরে থাকাকালীন মেয়েকে সেখানকার বিখ্যাত কাগজ 'মেদিনী'-তে কবিতা দেওয়ার জন্য দারুণভাবে উৎসাহিত করলেন। মেয়েও লিখে ফেললেন, 'প্রার্থনা' ও 'উদাসিনী'- নামের দু'খানা কবিতা। ছাপাও হল যথারীতি। এই হল তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশের ইতিহাস। আসলে, চণ্ডীচরণ যথার্থই বুঝেছিলেন যে, তাঁর মেয়ের ভাবুক মনটি কল্পনার মুক্তক ছন্দে বাঁধা। তাই সেই মনটিকে মুক্তি দিতে আয়োজনের ত্রুটি রাখলেন না।
কবিতার সঙ্গে গণিত--ব্যাপারটা তেলেজলের মতো শোনাচ্ছে না? শোনালেও, সেই তেলেজলে মিলমিশ ঘটিয়েছিলেন চণ্ডীচরণ মেয়ের জীবনে। তিনি নিজে কামিনীকে সুন্দরভাবে সহজ করে গণিত শেখালেন। গণিতে কামিনী এমন পারঙ্গম হয়ে উঠলেন যে, ক্লাসের সহপাঠীরা কেউই তাঁর সঙ্গে পেরে উঠলেন না। তাই দেখে শিক্ষক শ্যামাচরণ বসু তাঁকে কিংবদন্তির বিদুষী 'লীলাবতী' বলে ডাকতে শুরু করলেন। সাহিত্যিকদের চরিতগাথায় গণিতের পাতকুয়োযাত্রার যে বিবরণ শুনতে আমরা অভ্যস্ত, কামিনীর জীবনে চণ্ডীচরণ তার অনুর্বর্তন ঘটতে দিলেন না।
মুন্সেফ চণ্ডীচরণ শুধু সাহিত্যিকই ছিলেন না, ছিলেন অসাধারণ পাঠকও। তাঁর ছিল বিশাল ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। তাতে ছিল বিবিধ বিষয়ক দেশ-বিদেশের অসংখ্য বই। ছেলেরা শুধুই চাকরি পাবার প্রত্যাশায় পড়াশুনো করবে--সেকালের ছেলেদের এই প্রবৃত্তি ও প্রবণতা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাঁর নিজের ছেলে নেই। তাই মেয়েকে দিয়েই প্রমাণ করতে চাইলেন যে, শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞানানন্দ উপভোগের জন্যও পড়াশুনো করা যায়। ফলে, সেই ছোট্ট বয়স থেকেই কামিনী হয়ে উঠলেন চণ্ডীচরণের লাইব্রেরির সেই বিবিধ বিষয়ক পুস্তকরাজির নিবিষ্ট পাঠক। দর্শন-সাহিত্য-ইতিহাস-বিজ্ঞান-পুরাণ প্রভৃতি বিষয়ে অল্পবয়সেই অর্জন করলেন গভীর জ্ঞান। অবশ্য তাতে তাঁর কবিতা জ্ঞানগম্ভীর জটিল ধাঁধা হয়ে উঠল না। প্রকৃত জ্ঞানের স্পর্শে বরং হয়ে উঠল সহজ ভাষায় স্পষ্ট কথার করতোয়া। ষোল বছর বয়সে লেখা তাঁর সুবিখ্যাত 'সুখ' কবিতাটির কয়েকটি প্রবাদ-পংক্তি উদ্ধৃত করলেই ব্যাপারটি বোঝা যাবে :
"পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।"
জীবন সম্পর্কে চণ্ডীচরণের একটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। সেই লক্ষ্যেই মেয়েকে চালিত করছিলেন তিনি। তাই কৃতিত্বের সঙ্গে কামিনী বিএ পাশ করার পরও তিনি চাইলেন না যে মেয়ে চাকরি করুন। কিন্তু, প্রথম চাকরির প্রস্তাব নাকচ করার পরও এলো দ্বিতীয় প্রস্তাব। বেথুন স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি। এবারও নাকচ করতে গেলে বন্ধুরা তাঁকে বোঝালেন যে, মেয়েরা চাকরি করলে সমাজে নারীশিক্ষার প্রসার হবে, মেয়েরা স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত হবে। তাঁরা আরও ব্যাখ্যা করব বললেন, "এমন অনেক ভদ্র রমণী আছেন যাহাদের মধ্যে স্বাবলম্বন প্রয়োজন। কিন্তু দৃষ্টান্তের অভাবে এইরূপ রমণীরাও স্বাধীন ভাবে কোন কাজ করিতে পারিতেছেন না। আপনি যদি ইহাকে কাজ করিতে দেন তাহা হইলে পরে আরও দশজন স্ত্রীলোক কার্য্য করিতে অগ্রসর হইবে।" চণ্ডীচরণ জেদি হলেও একবারেই গোঁয়ার ছিলেন না। তাই বন্ধুদের কথা তাঁর মনে ধরল। তিনি রাজি হলেন। ফলে, কামিনী শিক্ষিকা হয়ে গেলেন।
পঁচিশ বছর বয়সে কামিনীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেল। তাও বাবার আগ্রহে। পিতৃবন্ধু কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচ্ছ্বসিত ভূমিকাসহ। কাব্যগ্রন্থের নাম দেওয়া হল, 'আলো ও ছায়া'। কাব্যটি অসম্ভব জনপ্রিয় হল। সংস্করণের পর সংস্করণ হতে লাগল। সেই জনপ্রিয়তার নিরীখে কবি কামিনীর আলোচনায় কামিনীকে "আলো ও ছায়া'র রচয়িত্রী" বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ চালু হয়ে গেল। স্ট্যাটুটরি সিভিলিয়ান কেদার রায় কামিনীর কবিতার গুণগ্রাহী পাঠক তো ছিলেনই, এবার কাব্যটির একটি বিমুগ্ধতাময় ও বিস্তৃত আলোচনা ইংরেজিতে লিখে ফেললেন। এবং একটি পত্রিকায় সেটি প্রকাশও পেয়ে গেল। আর সেই প্রকাশিত লেখাটি কবি ও কবির গুণমুগ্ধ পাঠকটিকে কাছাকাছি এনে ফেলল। আলাপ-প্রলাপ থেকে একেবারে বিশ্ৰম্ভালাপের সুযোগ করে দিল। প্রেম পাল তুলল, তরী চলল টানা পাঁচ বছর। চণ্ডীচরণ মেয়ের এই স্বাধীন পছন্দকে সম্মান করলেন। আর পাঁচটি বাপের মতো এক্ষেত্রে কিছুতেই নিজের পছন্দ পঁচিশ-তিরিশ বছরের কন্যার উপর চাপিয়ে দেবার কোন চেষ্টাই করলেন না। সমাজ ও আচারসর্বস্বতার মুখে ঝাঁটা মেরে, বাল্যবিবাহ ও কুলীন কুলে গৌরীদানের রমরমার যুগে তিনি এতবড় একটা দৃষ্টান্ত রাখলেন, যা সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে চট করে ভাবাই যায় না!
ছেলেমেয়েদের জন্মের পর কামিনী কবিতা লেখাই প্রায় ছেড়ে দিলেন। ছেলেমেয়েরাই হয়ে উঠল তাঁর কাছে 'জীবন্ত কবিতা'। বাবা যেমন তাঁকে মানুষ করতে কোন শৈথিল্য দেখাননি, তিনিও দেখালেন না। বাবার শিক্ষা এখানেও ভুললেন না। তৈরি হল সন্তানদের নিয়ে তাঁর মায়াময় জগৎ। কিন্তু, তিনি কবিতা ছাড়লেও কবিতা তাঁকে ছাড়ল না। কুড়ি বছরের মধ্যে একে একে তিন পুত্রকন্যা ও স্বামীর মৃত্যু হল। 'জীবন্ত কবিতা'দের ধরে রাখতে পারলেন না, ফিরতে হল সেই ভাবলোকের কবিতার কাছে। নিদারুণ শোক বাল্মীকিকে লেখনি ধরিয়েছিল, তাঁকেও ধরিয়ে ছাড়ল। কনিষ্ঠ পুত্র অশোকের মৃত্যুতে অসহনীয় ব্যথায় লিখলেন, 'অশোক-সঙ্গীত'। ফের কবিতাই হয়ে উঠল তাঁর একমাত্র অবলম্বন। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু কবিতা রচনাই হয়ে উঠল তাঁর কাছে মুক্তির সাধনা, পিতা-নির্দিষ্ট 'mission'...
তথ্যঋণ : 'কামিনী রায়' - শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।