বাবা শ্যামলাল গাঙ্গুলীর সঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির যোগাযোগ বেশ পুরনো। সেখানে হিসেবদারীর কাজ করতেন তিনি। সেই সূত্রেই ভরা আষাঢ়ে পিরালি ব্রাহ্মণ পরিবারের বাড়িতে বউ হয়ে এলেন তাঁর মেয়ে মাতঙ্গিনী। সালটা ১২৭৫। 'গরিব বাড়ির' বছর আটেকের এক রোগা কালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হল সে সময় কলকাতার উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক জ্যোতি ঠাকুরের। কন্দর্র্প সম জ্যোতি ঠাকুরের পাশে কাদম্বরীকে দেখে অনেকেই কটাক্ষ করতে ছাড়েনি। তাঁর দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরই এই অসম বিবাহের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। মানে, গুনে যেন কোনভাবেই সমকক্ষ নন। শুরু থেকেই পরবাসের অবগুণ্ঠিতা জীবন। সেই অবগুণ্ঠিতা কিন্তু বেশি দিন আড়ালে থাকলেন না। একদিন হয়ে উঠেছিলেন ঠাকুরবাড়ির অন্যতম সেরা মুখ।
যেভাবে লুকনো জাদু কাঠির ছোঁয়ায় ফুলে ফলে লতায় বদলে দিয়েছিলেন একাকী ছাদ। গড়ে তুলেছিলেন নন্দন কানন, ঠিক সেভাবেই বদলের রঙ লেগেছিল তাঁর নিজস্ব অন্তর মহলেও। এক স্বাভাবিক নন্দন বোধ কাজ করত তাঁর মধ্যে। গান, সাহিত্য কিংবা সমাজের চেনা ছক- হেলায় পেরিয়ে যাওয়ার সাহস, সব জায়গাতেই ব্যক্তিত্বের দ্যুতি জ্বলজ্বল করে উঠত হাজার স্ফটিক বাতির আলোয়।
তাঁর ছাদের নন্দন কাননে সাহিত্য পাঠের আসর বসত বিকাল বেলায়। সেখানে থাকতেন জ্যোতি ঠাকুর, কিশোর রবি, বিহারীলাল, অক্ষয় চৌধুরীর মতো সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। তবে মূল আকর্ষণ কাদম্বরী। মা হারা রবির বড় কাছের মানুষ ছিলেন 'নতুন বৌঠান'। তাঁর কথা বলতে গিয়ে কবি লিখেছেন, ' বড় ভালোবাসতুম তাঁকে। তিনিও আমায় খুব ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসায় নতুন বৌঠান বাঙালি মেয়েদের সঙ্গে আমার প্রাণের তার বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন।' তবে এত আলোর মাঝখানেও জমে থাকা অন্ধকার টুকু যেন কিছুতেই পিছু ছাড়েনি।
নিঃসন্তান জীবন নিয়ে গঞ্জনা ছিলই। তার সঙ্গে সদা ব্যস্ত স্বামী একাকীত্ব পাথর হয়ে পথ আটকেছিল। খুব ভালোবাসতেন ননদ স্বর্ণ কুমারী দেবীর মেয়ে ঊর্মিলাকে। তাকে নিয়েই থাকতেন। একদিন আচমকাই সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে অকালে জীবন দীপ নিভে যায় তার। সেই দায়ও কাদম্বরীর ওপরএসে পড়ে। ' বাঁজা'র সঙ্গে যোগ হয় 'অপয়া' অপবাদ। আরও গুটিয়ে যান কাদম্বরী।
প্রিয় রবিও ক্রমশ দূরে। তার বাইরের জগৎ আর সদ্য বিবাহ জীবন নিয়ে।
বিষাদ ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ় হয়। অভিমান জমে জমে পাথর। কোথায় যাবেন কাদম্বরী। কার কাছে খুলবেন মনের আগল! সঙ্গী বিরল বিরস দিন এমনি এমনি কেটে যায়। সুরহীন। গান হীন। কথা হীন। মূক।
শেষ পর্যন্ত যেন ঝড়কেই সঙ্গী পেলেন তিনি। বিষাদের গরল মিশে গেল কালো আঁধারে। শোনা যায় স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জোব্বার পকেট থেকে নাকি সেকালের এক বিখ্যাত থিয়েটার অভিনেত্রীর চিঠি পেয়েছিলেন কিন্তু অভিযোগ, রাগের মানুষ তিনি ছিলেন না, শুধু সেদিন রাতে আফিমের মাত্রাটাকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন কাদম্বরী। পরদিন আর উঠলেন না। দিনটা এমনই এক ভরা গ্রীষ্মের বেলা, ১৯ এপ্রিল। ২১ তারিখ চিরতরে ছেড়ে গেলেন ঠাকুর বাড়ি।
কিন্তু তিনি চলে গিয়েও রয়ে গিয়েছেন। সেই নীরব, কালো, গভীর অভিমানী চোখকে কোনদিনই ভুলতে পারেন নি রবি। তাই তাঁর লেখায়, রেখায়, কবিতার পাতায় বারবার ফিরে এসেছেন অভিমানীনী সেই একা নারী। চলে গিয়েও এভাবেই। কখনও মানসী কখনও বা 'শ্রীমতী হে' হয়ে...