তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৮৭০-১৮৮০ এই সময়ে ঠাকুরবাড়ির সব চেয়ে আলোকিত ব্যক্তিত্ব। সেই সময়ের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহলের নজর থাকত তাঁর দিকে। তবু তিনি বিস্মৃত। স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া নির্বাসনে প্রিয় শহর আর মনে রাখেনি তাঁকে। ইতিহাসও ভুলেছে। কেবল মিউজিয়ামের কাচ ঘেরা আলমারী আর ফ্রেমবন্দি ছবিতে বেঁচে আছে তাঁর অস্তিত্ব।
সন ১২৫৬। ২২ বৈশাখ। মধ্যরাতে জন্ম হল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর সারদা দেবীর পঞ্চম সন্তান। মহর্ষি নাম রাখলেন 'জ্যোতিরিন্দ্রনাথ'। বাড়ির সকলের 'নতুন'।
নামের সঙ্গে মিল হয়েছিল চরিত্রের। সারাজীবন তিনি জ্যোতিষ্মান পুরুষ।
মাত্র সাত মাস বয়সে দীক্ষা হয়েছিল ব্রাহ্ম ধর্মে। তবে তাঁর ছোট বেলার ঠাকুর বাড়ি তখন যেন একটু আলাদা। ব্রাহ্ম ধর্মের কঠোর অনুশাসন চেপে বসেনি সে বাড়িতে। প্রিন্স দ্বারকনাথের বৈভবের ঔজ্জ্বল অম্লান। অর্থ সম্পদের গল্প মিথ হয়ে ভাসছে কলকাতা শহরের হাওয়ায়।
ছোটবেলায় হাতে ঘড়ি বাড়ির পাটশালাতেই। গুরুমশাইয়ের কাছে। তবে মেরে ধরে পড়া বার কায়দা, অনুশাসন তাঁর ভালো লাগেনি। বিতৃষ্ণা জন্মেছিল। তবে তাঁর ওপর প্রভাব পড়েছিল দুই দাদা সত্যেন্দ্রনাথ আর হেমেন্দ্রনাথের। নাটক, গান, ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষায় আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। সঙ্গে শরীর চর্চা, কুস্তি তো ছিলই।
নিয়মগন্ডীর শিক্ষা তাঁর ভালো না লাগলেও স্কুলে তাঁকে ভর্তি হতেই হয়েছিল। প্রথমে সেন্ট পলস স্কুল, তারপর মন্তেগু একাডেমি আর হিন্দু স্কুল। পরবর্তী সময়ে ক্যালকাটা কলেজ আর প্রেসিডেন্সি।
খুব কম দিন প্রেসিডেন্সির ছাত্র ছিলেন। নাটকের টানে মাঝপথেই ছেড়ে ছিলেন পড়া। শোনা যায় সৌমকান্তি, সুদর্শন জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে দেখতে ভিড় জমত।
ছবি আঁকার শুরুটাও ছাত্র অবস্থাতেই। পোট্রেট মানে প্রতিকৃতি আঁকতেন। শুরুটা হয়েছিল খেয়াল খুশিতেই। তারপর ছবি নেশা হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের সদস্য, স্কুলের শিক্ষক, চেনা-জানা বন্ধু বান্ধবের ছবি আঁকতেন। একবার বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর। প্রতিকৃতি আঁকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়নি। বিদ্যাসাগর প্রয়াত হন। তবে জমিদারির কাজে কুষ্টিয়ায় থাকা কালীন লালন সাঁইয়ের পোট্রেট তিনি এঁকেছিলেন। সেই ছবিই লালনের একমাত্র প্রতিকৃতি। প্রায় দু হাজার ছবি এঁকেছিলেন। একবার রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ইংল্যান্ডে প্রদর্শনীও হয়।
মঞ্চ তাঁকে আরও প্রবলভাবে টেনেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসর ছেড়েছিলেন এই টানেই। বাড়িতেই তৈরি করেছিলেন নাট্যদল। ১৮৬৫ সালে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্থাপন করেছিলেন জোড়াসাঁকো নাট্যশালা। প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হয় মাইকেল মধুসূদনের 'কৃষ্ণকুমারী'। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই নাটকে অহল্যা দেবী নামে এক সাহসী রানী চরিত্রে। এই সাফল্য তাঁকে নাটকের প্রতি আরও উৎসাহী করে তোলে। সে সময় স্বদেশী আন্দোলন প্রবল আকার নিচ্ছে। তিনি দেশাত্মবোধক গান, নাটক লিখতে শুরু করেন। নাটকের জন্য এক আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেন ১৮৭৪-এ। নাম ' বিদ্বাজন সমাগম'।
ট্র্যাজেডি বা কমেডি যাই লিখুন না কেন তাতে দেশ, সমাজের নানা দিক উঠে আসত। নাটক মানে শুধুমাত্র বিনোদন নয়, লোকশিক্ষা যাতে হয় সেদিকটিও থাকত সম্পূর্ণ ভাবে।'সরোজিনী', 'অশ্রুমতী', 'অলীকবাবু', 'মানময়ী', 'স্বপ্নময়ী' র মতো বহু নাটকের নিয়মিত মঞ্চ প্রদর্শন হত। প্রায় ১৩ টি মৌলিক নাটক লিখেছিলেন। ১৮৯৯-১৮৭৪ পর্যন্ত ১৭ টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত নাটকের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। তার মধ্যে কালিদাসের 'অভিজ্ঞনম শকুন্তলম' শুদ্রকের 'মৃচ্ছকটিক' ছিল। শেক্সপিয়রের নাটকও অনুবাদ করেছিলেন। একসময় মঞ্চের দুনিয়া থেকে বিদায় নেন তিনি। স্বেচ্ছায়। নতুন সময়ের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। স্বাগত জানিয়েছিলেন মন থেকেই। পিছুটান রাখেননি