জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রবীন্দ্রযুগ শুরু হওয়ার প্রাক-পর্বে সবচেয়ে আলোকিত পুরুষ তিনি। বিচিত্র জীবন। স্ফটিকের ঝাড়বাতির মতো তার বিচ্ছুরণ, আবার আচমকাই হারিয়ে যাওয়া।
মোরাবাদী পাহাড়ের নির্জনে শান্তি সন্ধান। শহর কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে যেন লালন সাঁইয়ের গান বেজে ওঠে। ব্রাহ্ম সঙ্গীতের প্রার্থনা মন্ত্রের উচ্চারণে মিলেমিশে যায়।
জটিল জীবনের উদভ্রান্ত কোলাহল থেকে নিষ্ক্রমণ খুঁজতে চাওয়া এক মুক্ত পুরুষ। বিপত্মীক।
মাত্র ৩৫ বছর বয়সে স্ত্রী কাদম্বরীকে হারিয়েছেন। আফিমের বিষে শেষ হয়ে গিয়েছে সে জীবন।
এই একটি মৃত্যু যেন নাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর গোটা জীবনের ভিতটাকে। পরবর্তী পর্বে একের পর এক ব্যর্থতা আর ভরাডুবি গল্প। স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ নিয়ে আনাচে-কানাচে গুঞ্জন।
ঘরে-বাইরের সমস্ত অনল যেন অন্য পূর্ণতার সন্ধানের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিল তাঁকে। অন্তরের গ্লানি, সংসারের ভার- এর শেষ কোথায়?
উত্তর তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। চেনা পরিসরের বাইরে। মৈনাকের মগ্নতায়। খাঁচার পাখিটা মুক্তির আকাশ খুঁজে পেল সেখানেই। পাহাড়ের কোলে ঘর বাঁধলেন নতুন করে। এ ঘর তাঁর একার। নিজের মতো আরশিনগর। অপাপবিদ্ধ প্রকৃতির গা ছুঁয়ে, নিজের সঙ্গে নিজের বসত। বাকি জীবন সেখানেই।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম পুত্র। সপ্তম সন্তান। মহর্ষির সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় জ্যোতিন্দ্রনাথ। গ্রীক দেবতার মতো পৌরুষ। চোখের তারায় ঝলকে ওঠা আভিজাত্যের সঙ্গে স্নিগ্ধ মেঘের ছায়া।
ঠাকুরবাড়ির চেনা ঘরানায় তিনি পাখোয়াজের সুরের মতো বেজে উঠেছিলেন। ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁকে ঘিরেই জমে উঠত ঠাকুরবাড়ির গানের পরিবেশ।
নাটক লিখতেন। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে তাঁর প্রধান পরিচয় হতেই পারত ‘নাট্যকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর’। কিন্তু বাংলা নাটকের অঙ্গনে গিরিশচন্দ্র ঘোষের পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে কলম থামালেন তিনি। আর কখনও নাট্যকারের ভূমিকায় দেখা যায়নি তাঁকে। মঞ্চ থেকে স্বেচ্ছা প্রস্থান।
ইংরাজি, সংস্কৃত , সঙ্গে সঙ্গে চর্চা চলত মারাঠী আর ফার্সীর। সঙ্গে সেতার, পিয়ানো, হারমোনিয়াম। তালিমে-তালিমে হয়ে উঠেছিলেন ওস্তাদ বাজিয়ে ।
আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের আসনে ছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ থেকে গা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। তাঁর কাজে-কর্মে, ব্যক্তিগত জীবন চর্চার তার ছাপ পড়েছিল সরাসরি। ‘কমিটি অব ফাইভ, ‘সঞ্জীবনী সভা’ এসব নিয়ে মেতে থাকলেও তাঁর ওপর ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারী সামলাবার দায়। দেবেন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে। কলকাতা ছেড়ে নিয়মিত থাকতে হত কটক-শিলাইদহে।
সঙ্গে ছিল ব্যবসার আকর্ষণ। কিছুটা প্রিন্স দ্বারকানাথের জিনের উত্তরাধিকার আর কিছুটা স্বদেশী প্রভাবে- এই দুই অনুঘটকের টানে পাট, নীল আর জাহাজের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু কোনটাতেই সাফল্য আসেনি।
সংস্কৃত নাটকের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। নাটকের দুনিয়া থেকে সরে আসার পরি তিনি অনুবাদ সাহিত্যে ডুবে দেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর অনুরোধে। চার বছরে সতেরোটি নাটক অনুবাদ করেন। করেছেন। ‘ভারতী’র মত একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।
লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক বিরচিত “শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতারহস্যে”র বাংলা অনুবাদ। প্রায় সাত আট বৎসর ধরে এই মহাগ্রন্থের অনুবাদ করেন তিনি।
পোট্রেট আঁকা তাঁর নেশা ছিল। লালন ফকিরের একমাত্র প্রতিকৃতি তাঁরই আঁকা। এছাড়া পরিবারের সদস্য, বন্ধু, কাছের মানুষদের অজস্র ছবি তিনি এঁকেছিলেন। প্রায় ১৮০০ স্কেচ সংরক্ষিত আছে আজও। রবীন্দ্রনাথ ও রোদেনস্টাইনের উদ্যোগে ১৯১৪ সালে এই স্কেচগুলি নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়।
নিজেকে বিপুল কর্মকান্ডে জড়িয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। ছবি হোক বা লেখা, নাহলে সভা-সংসদের কাজ সবেতেই তাঁর জ্বলজ্বলে ভূমিকা।
কিন্তু স্ত্রী’র মৃত্যু এবং পরবর্তী পরিস্থিতি তাঁকে ক্রমশ যেন একা করে দিচ্ছিল প্রতিদিন। কোথাও যেন মনের চেনা চলনে অচেনা ছন্দ। অন্তরের দহনে জরুরী ছিল শুশ্রূষা। তাই পাহাড়ের অবকাশ। অবকাশ আর ‘অবকাশ’ থাকেনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনে। সেই উঠেছিল ঘরে ফেরার ঘর।
স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর স্মৃতি কথায় বলেছেন, ” কি আদর যত্নে, কি আনন্দ উৎসবে দিনগুলি অতিবাহিত হইত, তাহা এখন যেন স্বপ্নের মত বলিয়া মনে হয়। তাঁরা উভয়েই (সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) প্রত্যহ প্রাতে শাঁখ ঘন্টা কাঁসর ধ্বনির আহ্বানে, যে কুসুম গাছের তলায় উপাসনা করিতেন সেই শানবাঁধানো বেদীতলে বসিয়া আমিও তাঁহাদের সহিত উপাসনায় যোগদান করিতাম মনে হইত যেন সেই পুরাকালের যোগী ঋষির তপোবনে বসিয়াই ঈশ্বর -আরাধনায় ব্রতী হইয়াছি।”
স্বেচ্ছায় একা। অথবা এক দৃপ্ত বিবাগী পুরুষের বৈধব্যযাপন। নিঃসীম পাহাড়ে একান্তে বিচ্ছেদের উদযাপন। বেদনার অভিঘাত স্নাত হয়ে যায় অসীম চরাচরের ব্যপ্তিতে। ‘শান্তিধাম’ নামটিও যেন তাই ভেবেই দেওয়া।
শান্তিধাম থেকে কখনও সেভাবে ফিরতে চাননি তিনি। তবে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলই। আদরে-অভিমানে শেষদিন পর্যন্ত থেকে গিয়েছিলেন তাদের সম্ভাষনের ডাকে।
এমনই এক বসন্তে হঠাৎ মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল মোরাবাদী পাহাড়ে। সন্ধের আকাশে তখন বিষাদ মেঘের ঘোর। নিভে গেলেন তিনি। ঠাকুর বাড়ির ‘জ্যোতি ঠাকুর’। দিনটা মার্চের ৪ তারিখ। সালটা ১৯২৫।
চেনা ঘর, দোর-দালান ছাড়িয়ে। অনেকটা দূরে। স্বজন-বান্ধবহীন, একা যাপনে।
তবু তিনি নক্ষত্র। রবির আলোর ছটাতেও অম্লান তাঁর জেগে থাকা।