ডাক নাম, রেণু। ভালো নাম, যূথিকা। যূথিকা রায়। জন্ম, হাওড়ার আমতায়। ১৯২০ সালের ২০ এপ্রিল। হাওড়ায় জন্ম হলেও যূথিকার মেয়েবেলা কেটেছিল খুলনার সেনহাটিতে। কেননা, বাবার ছিল বদলির চাকরি। সেনহাটি ,বাংলার আর-পাঁচটা গ্রাম যেমন হয়, সেনহাটি ছিল তেমনই একটি গ্রাম। উদার প্রকৃতি, অনন্ত মাঠ, মেঠো গানের সুর, পল্লীর অনাবিল আত্মীয়তা, কারণ-অকারণের বিরাগ, অভাব, দারিদ্র্য, মেয়েদের শিক্ষাহীন জীবন—এ সমস্তই ছিল সেখানে। ফলে, এই গ্রামের জীবন ও প্রকৃতি যূথিকার বাল্যজীবনকে নানান অভিজ্ঞতায় যেমন সমৃদ্ধ করতে শুরু করেছিল, তেমনি তাঁর সঙ্গীতজীবনের সূচনাতেও বেশ ভূমিকা নিয়েছিল।
জন্ম থেকেই সঙ্গীতের প্রতি যে ভালোবাসা নিয়ে যূথিকা জন্মেছিলেন, সেই ভালবাসায় রঙ ধরিয়েছিল পল্লীর সেই আবহমান মেঠোগানের সুর। বাবা সত্যেন্দ্রনাথ নিজে ভালো গান জানতেন। সঙ্গীতের প্রতি বাল্যেই মেয়ের আগ্রহ দেখে তিনি নিজেই শেখাতে শুরু করলেন গান। পাঠাতে লাগলেন গাঁয়ের স্কুলে। সেই ছোট্টবেলাতেই গাঁয়ের স্কুলে, পাড়ার অনুষ্ঠানে যূথিকার সুরেলা কণ্ঠে গান শুনে সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। তাতে বাপ-মেয়ের উৎসাহ আরও কয়েক গুণ বাড়ল।
সেনহাটিতে থাকতেন প্রখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্তের বোন সুধীরা। কমল দাশগুপ্তেরা তিন ভাই—বিমল, কমল, সুবল—তিনজনই সঙ্গীতে নিজের নিজের মতো করে কৃতী। একদিন যূথিকার কণ্ঠে গান শুনে সুধীরার বেশ ভালো লাগল। তিনি যেচে বড়দা বিমলের কাছে নিয়ে গিয়ে শেখানোর পরামর্শ দিলেন। কথাটা বেশ মনে ধরল সত্যেন্দ্রনাথের। কেননা, বিমল থাকেন কলকাতায়। সেখানে শেখা এবং সঙ্গীতকে সম্বল করে ‘হয়ে ওঠা’র সুযোগ বেশি।
যূথিকার বয়স তখন সবে সাত। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন কলকাতায়। হাজির হলেন বিমল দাশগুপ্তের কাছে। কিন্তু কেন জানি না বিমলবাবু ছোট্ট যূথিকাকে গান শেখাতে একেবারেই রাজি হলেন না। সুধীরার কথায় বড় আশা নিয়ে এসেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। কাজেই ‘না’ শুনে তিনি বেজায় হতাশ হলেন। হতাশ হয়েই ফিরতে যাচ্ছিলেন সেনহাটি, অমনি চোখে পড়ল কাগজে রেডিওতে অডিশনের বিজ্ঞাপন। মনে জ্বলল খানিক আশার আলো। মেয়েকে নিয়ে ছুটলেন গারস্টিন প্লেসে। সেখানে খালি গলায় যূথিকা গাইলেন রবীন্দ্রনাথের গান, ‘আর রেখো না আঁধারে’। বলা বাহুল্য, এই এক গানই তাঁর কণ্ঠ মাধুর্যে সকলের চিত্ত হরণ করল এবং এই বয়সেই হয়ে উঠলেন রেডিওর বাঁধা শিল্পী।
কাজেই মেয়ের জন্য বাবাকে বদলির চাকরির সুযোগ নিয়ে ফের পাতাতাড়ি গুটিয়ে কলকাতায় আসতে হল। সত্যেন্দ্রনাথ জানতেন শিক্ষা, নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাই মেয়েকে শিল্পী হিসেবে ‘হয়ে উঠতে’ সাহায্য করবে। তাই শুরু হল সঙ্গীত শিক্ষাগুরুর খোঁজ। পেলেন বরানগরের জ্ঞানরঞ্জন সেনগুপ্ত মহাশয়কে। তাঁর কাছেই চলতে লাগল যূথিকার তালিম।
জ্ঞানরঞ্জনের বাড়িতে সঙ্গীতসূত্রে আসতেন কাজী নজরুল ইসলাম। এখানেই যূথিকার কণ্ঠে গান শুনে তিনি এমন মুগ্ধ হলেন যে, মল্লার রাগে আস্ত একখানা গানই লিখে ফেললেন, ‘স্নিগ্ধ শ্যামবেণীবর্ণা’। নিজে সেই গান শেখালেন যূথিকাকে। যূথিকা গাইলেনও অপূর্ব। নজরুল তখন এইচএমভি’র ট্রেনার। কাজেই যূথিকাকে নিয়ে এইচএমভি-তে এসে একদিন গানটি রেকর্ড করে ফেললেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বাজারের দোহাই দিয়ে রেকর্ডটি প্রকাশিত হল না। তখন যূথিকার বয়স মাত্র তের।
তেরয় না বেরলেও চোদ্দ বছর বয়সে যূথিকার গানের রেকর্ড ঠিক বেরুল। এক বছর আগের বাতিল রেকর্ডটি হাতে এল সুরকার কমল দাশগুপ্তের। তিনি তখন এইচএমভি’র নতুন ট্রেনার হয়ে এসেছেন। নজরুল হয়েছেন রিট্রেনার। বাতিল রেকর্ডে যূথিকার কণ্ঠ শুনে অপার মুগ্ধতায় কমল ঠিক করে ফেললেন, এঁকে দিয়েই গাওয়াবেন। অমনি প্রণব রায়কে দিয়ে লিখিয়ে নিলেন নতুন দুটি গান, যূথিকারই জন্য—‘ভোরের যূথিকা আমি’ এবং সাঁঝের তারকা আমি’। রেকর্ডও করে ফেললেন।
কিন্তু আবার আগের বছরের মতোই বাজারের দোহাই দিয়ে এবং নতুন কণ্ঠের গান বিক্রি না-হওয়ার দোহাই দিয়ে কোম্পানির বোর্ড এই রেকর্ডটিকেও চেপে দিতে চাইল। তবে এবার ব্যাপারটা অত সহজে ঘটানো গেল না। কমল ও যূথিকার পাশে এসে দাঁড়ালেন নজরুল। মূলত তাঁরই অদম্য জেদে প্রকাশিত হল যূথিকার প্রথম রেকর্ড। সালটা ১৯৩৪। রেকর্ড বিক্রিতেও রেকর্ড করল যূথিকার গান। পাল্টে দিল জনপ্রিয়তার পূর্বতন ইতিহাস। রাতারাতি যূথিকা বাঙালির ঘরে ঘরে ঠাঁই পেয়ে হয়ে উঠলেন প্রতিষ্ঠিত ও বিখ্যাত।
কমল দাশগুপ্তের হাত ধরে এই যে সুর ও কণ্ঠের যুগলবন্দিতে তাঁর রেকর্ড-জীবনের সূত্রপাত হল, তার ধারবাহিকতা প্রবাহিত হয়ে চলল ক্রমান্বয়ে। আধুনিক গানে তো বটেই, এমনকি ভজনগানেও তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। বাংলার পাশাপাশি হিন্দিতে গান গেয়ে তিনি সর্বভারতীয় শ্রোতার কাছেও অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠলেন। হিন্দি ভজনের মুগ্ধ-শ্রোতা হিসেবে পেলেন মহাত্মা গান্ধি ও জওহরলাল নেহেরুর মতো মানুষদের।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, সকালে জওহরলাল যখন লালকেল্লায় ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও শোভাযাত্রার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তখন হঠাৎ দিল্লি বেতার কেন্দ্রে ফোন করে তিনি অনুরোধ জানালেন, পতাকা উত্তোলন ও শোভাযাত্রার সময়টায় বেতারে যেন যূথিকা সঙ্গীত পরিবেশন করেন, এটাই তাঁর ইচ্ছে। ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এ এক বিরল ও অমূল্য সম্মান। গর্বের কথা, এই সম্মান বাঙালি শিল্পী যূথিকা ছাড়া আর কারও ভাগ্যে সেদিন জোটেনি।
ভাগ্য ভাল, সেদিন সেখানে যূথিকার রেকর্ডিং ছিল। রেকর্ডিং শেষ করে তিনি চলেই যাচ্ছিলেন কিন্তু অফিসার ছুটে এসে জওহরলালের অনুরোধ ব্যক্ত করতেই তিনি সানন্দে আবার স্টুডিওতে প্রবেশ করে গান শুরু করলেন--'সোনে কা হিন্দুস্তান মেরা'। তাঁরই রেকর্ডের অসাধারণ এক দেশাত্মবোধক গান এটি। এ-গানের পর আরও এক ঘন্টা ধরে যূথিকা পরিবেশন করলেন অপূর্ব সব ভজন।
বিরল সম্মান আর অনন্য স্মৃতিসমৃদ্ধ জীবনের অধিকারিণী এই শিল্পী সুদীর্ঘ সঙ্গীতসাধনায় আমাদের ভরিয়ে দিয়ে গেছেন 'এমনই বরষা ছিল সেদিন', 'ওরে নীল যমুনার জল', 'মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে', 'ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়', 'এই যমুনারি তীরে' প্রভৃতি গানে আর সুধাস্বরে। কালের ধ্বনি বেয়ে সমকাল পেরিয়ে গান যদি চিরকালের হয়ে ওঠে, সেখানেই শিল্পীর সার্থকতা। এই পথেই যূথিকা সার্থক শিল্পী তো বটেনই, সঙ্গীতরসিকের শ্রুতিতে অমলিন আবেদনে সুধাদায়িনী শিল্পীও...