বাল্মীকি ও জীবনানন্দ: দুই কবির এক ভাষ্য

দুটি কোঁচপাখি নিপুণ কামক্রীড়ায় মগ্ন ছিল। কিন্তু কালান্তক এক ব্যাধ তির ছুঁড়ে সহসা তাদের মধ্যে পুরুষটিকে মেরে ফেলল। দয়িতের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে স্ত্রীটি বিহ্বল হল, শোকাকুল হল এবং বুকফাটা বিলাপ করে কাঁদতে শুরু করল। নদীতে স্নান করতে এসে তীরস্থ অরণ্যে এই সমগ্র দৃশ্যমালা দেখে যুগপৎ ব্যাকুল, শোকগ্রস্ত ও ক্রুদ্ধ হলেন মহর্ষি বাল্মীকি। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল আদি শ্লোক, কাব্যের অবয়বে অমোঘ অভিশাপ:

'মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।

যৎ ক্ৰৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্॥'

শ্লোকটির আক্ষরিক অর্থ, ‘ওরে নিষাদ! তুই মিথুন নিরত ক্ৰৌঞ্চদের একটিকে বধ করেছিস, সে-কারণেই কোনদিন তুই প্রতিষ্ঠা পাবি না!‘

এখানেই আমার প্রশ্ন, অভিশাপের প্রচলিত বহুধা বয়ান থাকতে বাল্মীকি ব্যাধকে হঠাৎ করে 'প্রতিষ্ঠা পাবি না!' বলতে গেলেন কেন? সেকালের রীতি অনুযায়ী তিনি ব্যাধকে ওভাবেই অতৃপ্তকামে ও অপঘাতে মৃত্যুর অভিশাপ দিতে পারতেন, তপ-জোরে সাক্ষাৎ ভস্ম করে ফেলতে পারতেন, কিংবা অন্যতর শাস্তির বিধান দিতে পারতেন। তা না করে তিনি এই যে অপ্রতিষ্ঠিত থাকার শাপটি দিলেন, এখন ধরে নিতে হবে, তার নিশ্চয়ই গূঢ় কোন কারণ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটি কী?

নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সেটি হচ্ছে 'জেনোসাইড'। অরণ্যের আশ্রয়ে প্রাগৈতিহাসিক অধিকার আছে বিহঙ্গের। সেই অরণ্যকেই জীবিকা করে তার উপকণ্ঠকে আবাসভূমি করেছে ব্যাধ কোন এক ঐতিহাসিক কালে। অরণ্যের বিহঙ্গ বা পশুকুলকে খতম করে ফেলতে চায় সে, নিশ্চিহ্ন করতে চায় অবলীলায়। তাই সে মিথুনরত অসহায় ও অতৃপ্ত কোঁচটিকে বধ করেছে। কোঁচটি যে শুধু আপন আশ্লেষ মেটাতে মৈথুনে মগ্ন হয়েছে, এমনটা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রজননের প্রবাহে আপন প্রজাতিকে বহুর আকারে বিকাশ ঘটাতে চাওয়াও।

ফলে, মৈথুনরত কোঁচটিকে বধ করার ঘটনাটি শুধু একটি হত্যার ঘটনা হয়েই থেমে থাকে না। তা একটি অরণ্যচারী আদিম জাতির প্রজনন ও প্রবাহকে স্তব্ধ করে নিঃশেষ করে দেওয়ার ঘৃণ্য পদক্ষেপ হয়ে ওঠে। সেই পথেই ব্যাধের মধ্যে যে গুপ্ত অভিপ্রায়টি দেখা যায় তা হল, নিজের প্রজাতিকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে তুলে ধরে অরণ্য অধিকার করার প্রচেষ্টা।

উপরোক্ত দৃষ্টিতে কোঁচ হয়ে ওঠে আদিম কৌম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং ব্যাধ আগ্রাসী বহিরাগত। ঘটনাটি হয়ে ওঠে 'জেনোসাইডের' এক নির্মম দলিল। এক-কে ধ্বংস করে অন্যের আত্মপ্রতিষ্ঠার এই যে চক্রান্ত, তার বিরুদ্ধেই বাল্মীকি তর্জনি তুলে বলেন, 'ওরে, তুই জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবি না!'

আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের 'শিকার' কবিতায় এক অর্থে আমরা এই জেনোসাইডেরই চূড়ান্ত প্রতিচ্ছবি পাই। তিনি বাল্মীকির মতো কোন সহজ তর্জনি উত্থাপন করেননি ঠিকই, কিন্তু যে মর্মঘাতী শব্দাবলীর বিন্যাসে দৃশ্য পরম্পরায় নির্মম হত্যার ছবি এঁকেছেন, তা উদ্যত তর্জনির চেয়ে কম কিছু না।

কবিতায় উপনিবেশবাদী তথাকথিত যে টেরিকাটা আধুনিক সভ্যতার লোকগুলো সুন্দর সকালটিকে বিষাক্ত করে তুলেছিল, তারা অরণ্যে বহিরাগত। অরণ্যের সন্তান বাদামি হরিণটি অরণ্যের সমস্ত ক্রূরতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল নরম সুন্দর এক সকালে। ভেবেছিল, তার সৌন্দর্যে একগুচ্ছ হরিণীকে সে মোহিত করে ফেলবে। রচনা করবে প্রণয়ের পথ। তারপর বসবাস, সহবাস-নির্মিত হবে অরণ্যের সহজ সত্য। 'সূর্যের সোনার বর্শা' পুরুষের জননযন্ত্রের প্রতীক পেরিয়ে এগিয়ে দেবে বংশের ধারা:

"ভোর;

সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে-বাঁচিয়ে

নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে-ঘুরে

সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিলো।

... ... ... ... ... ... ... ... ...

এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতো জেগে উঠে

সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য।"

কিন্তু বাদামি হরিণটি ভাবতে পারেনি যে, তার চেনা অরণ্যে অচেনা ক্রূরতারও অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। তাই সে জানতেও পারেনি, তা থেকে বাঁচার উপায়। বাল্মীকির পুরুষ কোঁচপাখিটির মতো এখানেও টেরিকাটা লোকগুলোর দোনলা বন্দুকের নিশানা হয়ে ওঠে পুরুষ হরিণটি। প্রজননের প্রত্যাশা নিয়ে সে-ও নিহত হয়। হয়ে ওঠে শখের আহার। 'আহার' শব্দটি অধুনা বহুধা ব্যঞ্জনাময়ী। একটি জাতি বা উপজাতিকে শেষ করে দেওয়া বোঝানো যেতে পারে 'খেয়ে নিয়েছে' বললেই!

বলা বাহুল্য, শেষ পর্যন্ত আদিকবির আদি শ্লোকের ক্রৌঞ্চ ও জীবনানন্দের হরিণ সমান অবস্থানে এসে দাঁড়ায়। দুটি জীবই হয়ে ওঠে আদিম অরণ্যচারী কৌমজাতির প্রতিভূ। যৌনতৃষ্ণা ও প্রজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বাসনা নিয়ে যারা নিহত হয়। তাদের নিশ্চিহ্ন করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার আদিম অভ্যাসে এগিয়ে চলে ঘাতক। আদিকবির ব্যাধ জীবনানন্দে এসে দোনলা বন্দুক হাতে টেরিকাটতে শিখে যায়। কয়েক সহস্র দশক পেরিয়েও চিত্র বদলায় না। জেনোসাইড।

পারিবারিক হিংসার মতো পেটোয়া মিডিয়ার নাগাল পেরিয়ে অরণ্যজীবন ও অরণ্যচারী আদিম জনজাতিকে সভ্যতার অগ্রগতির নামে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার খেলা আজও চলতে থাকে সমানে। আর তারই বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে বাল্মীকি এবং জীবনানন্দ দুস্তর কালের ব্যবধান পেরিয়ে দৃশ্য ও অদৃশ্য তর্জনি নিয়ে আমার কাছে আপন ভাষ্যে উজ্জ্বল হয়ে অমলিন রয়ে যান...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...