এক বইপাগলের আখড়ায়

৮ নম্বর রাধানাথ মল্লিক লেনের বাড়ির তিনতলার ঘর। সেখানে তিনটে বড় বড় আলমারি। সব বই ভর্তি। বই রাখার আর জায়গা নেই।

অগত্যা ঠাঁই নিলেন বাড়ির পাশের পাড়ায় সূর্য সেন স্ট্রিটের লাগোয়া পটুয়াটোলা লেনের অমিয় নিবাসে (অধুনা লুপ্ত)। তিনতলার দুটো ঘর। শুধুমাত্র বইয়ের সঙ্গে বসত করবেন বলে।  

থাকতেন বইয়ের রাজত্বে। দুটো ঘর হয়ে উঠেছিল তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরী।

ঘরের মেঝে। আলমারির মাথা। বিছানা। কোথাও ফাঁক নেই। থরে থরে শুধু বই। বাংলা-ইংরেজি নানা রকম। দেশ-বিদেশের বইয়ের সংগ্রহ দেখলে অবাক হতে হয়। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সিনেমা সংক্রান্ত। একটা শোকেস ভর্তি শুধু মূল্যবান বিদেশি বইয়ে। থিয়েটার, বিজ্ঞান, সাহিত্য কিছু বাদ নেই।

কলেজ স্ট্রীট পাড়ায় নতুন বই এলেই পৌঁছে যেত তাঁর ঘরে।  

অভিনয়ের রসদ আসত বইচর্চা থেকেই। মগজ আর হৃদয় মিলেমিশে যেত তাতে। অভিনয় বাদ দিয়ে বেশিরভাগ সময়টা দিতেন পড়াশোনাতেই। আদ্যন্ত বইপাগল এক মানুষ।

সাদাসিধে অনাড়ম্বর ব্যক্তিগত জীবন। কিন্তু বই কেনার ক্ষেত্রে কখনও দু’বার ভাবতেন না।

স্বাভাবিক প্রতিভার সঙ্গে মিশেছিল পড়াশোনার জৌলুস। মঞ্চে, পর্দায় বারবার ঘটত তারই বিচ্ছুরণ।

জন্ম বাংলাদেশের বরিশালে। অনেকটা পড়াশোনা পাটনায়। পাটনার কলেজে বি.এ কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। একটা সময়ে প্রুফ রিডারের চাকরি করতেন।

অমিয় নিবাসের ঘর একদিকে ছিল তাঁর লাইব্রেরি, অন্যদিকে আবার অফিস। কাজের জগতের মানুষদের সঙ্গে দেখা করতেন এখানেই।

ঘরের টেবিলে চোখ গেলে দেখা যেত, টেবিলের ওপর রাখা বিভিন্ন স্কুলের বুক লিস্ট। আশেপাশের দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের স্কুলের বুকলিস্ট সেসব।

প্রতি জানুয়ারি মাসে স্কুলে পড়াশোনার নতুন বছর শুরু হলে, বুকলিস্ট অনুযায়ী বই কিনে পাঠিয়ে দিতেন তাদের।

অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা থেকে ছেলেমেয়েরা যাতে হারিয়ে না যায়, তাতে বাঁধ দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা।

বই পড়ার অভ্যেস ছড়িয়ে দিতে চাইতেন অন্যদের মধ্যেও। কোনও বই নিজের ভালো লাগলে চেনাজানাদের পড়িয়ে আনন্দ পেতেন।

জহর রায়ের বই পড়ার নেশা তাঁর চেনা পরিসর থেকে টালিগঞ্জ পাড়ার সহকর্মী কারও অজানা ছিল না। পান্ডিত্যের আস্ফালন কখনও এতটুকু দেখা যায়নি।

পর্দায় কমেডিয়ান, ব্যক্তিগত জীবনে একেবারে অন্য মেজাজের মানুষ। রাশভারী। গম্ভীর। নিয়মনিষ্ঠ। চারপাশ সম্বন্ধে সদা সচেতন।  

শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের স্বরাজ লাইব্রেরীর সদস্য ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ যেদিন স্বাধীন হয়েছিল সেদিন প্রতিষ্ঠিত হয় এই লাইব্রেরী।

প্রতিদিন বই পালটাতে আসতেন জহর রায়। একটা দিনও বাদ পড়েনি।

পরবর্তী সময়ে নিজের সংগৃহীত বইয়ের একটা বড় অংশ তিনি পাঠাগারকে দান করে গিয়েছিলেন।   

মৃত্যুর পর তাঁর বইয়ের বিপুল সংগ্রহ দান করে দেওয়া হয়। সংগৃহীত বইয়ের অংশ দেওয়া হয় ন্যাশনাল লাইব্রেরী এবং নন্দনে। সংরক্ষণের অভাবে বিক্রিও করে দিতে হয় কিছু।  

 

 

   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...