বাবা সতু রায় ছিলেন অভিনয়ের মানুষ। নির্বাক যুগের বেশ কিছু সিনেমায় তাঁকে দেখা গিয়েছিল। ভালো লিখতে পারতেন। সেই প্রভাব পড়েছিল ছেলের ওপরও । পাটনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘চার্লি চ্যাপলিন’কে নকল করে দেখাতেন।
সেই সময় পাটনার মানুষের মুখে ‘চার্লি’ হিসেবে তাঁর পরিচিতিও ছড়িয়েছিল।
একদিন অভিনয়ের টানে পা রাখলেন কলকাতায়। তারপরের পথটা যেন নিয়তি নির্দিষ্ট। সেই পথেই তিনি বাংলার রুপোলী দুনিয়ার রসরাজ। জহর রায়।
১৯১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জহর রায়ের জন্ম বাংলাদেশের বরিশালে। বাবার চাকরি সূত্রে চলে যেতে হয় পাটনায়।
রুটি রুজির জন্য কখনও মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ, কখনো প্রেসে প্রুফরিডার আবার কখনও দর্জির দোকান। সেলাই-ফোড়াই দিয়ে অন্ন সংস্থান।
অভিনয় যাঁর রক্তে, চার্লি যার দিন-রাত জুড়ে আছে তাঁর মুক্তি নেই। সিনেমা তাঁকে নিশির ডাকের মত টানত। তাই একদিন চেপে পড়লেন ট্রেনে। কলকাতাগামী এক বরযাত্রীদলের সঙ্গে কলকাতা। পকেটে সম্বল মাত্র ৫০ টাকা।
দেখা করলেন চিত্র পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। জহর রায় তাঁকে কালাচাঁদদা নামে ডাকতেন। তাঁর ছবি দিয়েই বাংলা সিনেমার জগতে পা রাখলেন জহর রায়। সালটা ১৯৪৭। মুক্তি পেল ‘পূর্বরাগ’। তারপর টানা ৩০ বছর। প্রায় ৩০০-টির বেশি সিনেমা। সব রকমের কমেডি অভিনয়, স্যাটাইয়ার এমনকি ডার্ক কমেডিতেও অপ্রতিরোধ্য।
জহর রায়ের অসাধারণত্ব ছিল সংলাপ বলার দক্ষতায়। গোটা শরীর দিয়ে অভিনয় করতেন তিনি। পড়াশোনার চর্চা আর মেধার ঝলক দেখা যেত অভিনয়ের ক্ষেত্রে। রসবোধ, রুচি, শিক্ষা, সূক্ষতা সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মানের সেরিব্রাল অভিনেতা।
সেসময়ের মেইনস্ট্রিম বাংলা ছবিতেও ছিলেন। আবার সত্যজিৎ- ঋত্বিক-মৃণালের অন্যধারার ছবিতেও সমানভাবে দেখা গিয়েছিল জহর রায়কে।
জহর রায়ের বসত বাড়ি মধ্য কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে। ২১/১ রাধানাথ মল্লিক লেনে। কিন্তু তিনি থাকতেন পটুয়াটোলা লেনের ‘অমিয় নিবাসে’। সেই বাড়ির দুটো ঘর জুড়ে তাঁর অফিস। আর বই। বইয়ের নেশা ছিল তাঁর। দেশ- বিদেশের বহু দুস্প্রাপ্য বই ছিল সংগ্রহে।
নিজে নিজে তৈরি করতেন কমিক। সেভাবেই লিখেছেন ‘ন্যাপাসুর বধ’, ‘টাঙ্গাওয়ালা’র মতো বিখ্যাত সব কৌতুক নকশা। মেগাগ্রামফোন কোম্পানি থেকে রেকর্ড বেরিয়েছিল। দুর্গাপুজোর সময় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজত সেসব রেকর্ড।
ষাট-সত্তরের দশকে তাঁকে ছাড়া জলসা ভাবাই যেত না।
সিনেমায় অভিনয়ের পাশাপাশি মঞ্চ অভিনেয়ের ক্ষেত্রেও সমান দাপট। ষাটের দশকে বন্ধ হয়ে যাতে বসা রংমহল থিয়েটার বাঁচিয়ে রাখার দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন। সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে মিলে গঠিত হয় ‘রংমহল শিল্পগোষ্ঠী’। ‘উল্কা’, ‘সুবর্ণগোলক’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। একের পর এক হাউসফুল শো। নতুন মুখদেরও দেখা যেত সেই সব অভিনয়ে। সেভাবেই মঞ্চে এসেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তী।
জহর রায়ের কথা হবে আর ভানু আসবেন না তা কী হয়! জহর রায় চলচ্চিত্র জগতে আসেন স্বাধীনতার বছরে। তার ঠিক দু’বছর পর ভানু বন্দোপাধ্যায়। দুজনেই মূলত কমেডি অভিনেতা। দুজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভানু জহরকে ডাকতেন ‘জহুরে’ বলে আর জহর ভানুকে ‘ভেনো’। দুজনের মধ্যে মিল প্রচুর আবার অমিলও কম নয়। পর্দায় তাঁরা ম্যাজিক দেখাতেন। ১৯৫২-৬২ বাংলার ‘উল্টোরথ’ পুরস্কারের প্রাপক এই জুটি। একবারও মিস নেই। জহর-ভানু সিনে থাকলে দর্শকরা অন্য দিকে চোখ ফেরাবার ফুরসৎ পেত না। সেই গল্প বললেন, ভানু বন্দোপাধায়ের ছেলে গৌতম বন্দোপাধ্যায়।
দুজনে ভেবেছিলেন শিবরামের হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন করবেন। কিন্তু আচমকাই থেমে গেল সব কিছু। ভেঙ্গে গেল বাংলা সিনেমা জগতের অন্যতম হিট জুটি।
১৯৭৭ এর ১১ আগস্ট। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ফোন, ‘মেডিকেল কলেজে জহর রায়দা মারা গেছেন। ভানুদাকে একটু খবর দিতে পারেন?’
‘চার্লির’ শেষ যাত্রায় কপালে চুম্বনরেখা এঁকে দিয়েছিলেন বলিউডের গ্রেটা গার্বো। আকুল হয়ে কেঁদেছিলেন বন্ধু ভানু।
ক্রমশ বদলে যাচ্ছে শহর। অফুরান হাসির সহজ জীবনে আজ জটিলতার বেড়ি। বাস্তবের সঙ্গে টিকে থকার যুদ্ধে লড়তে লড়তে মানুষ আজ ক্লান্ত সৈনিক। সেই ক্লান্তিতে আলো ছড়ান মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে হাসির রাজা। জহর রায়।
বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন অক্ষয় আয়ুরেখায় বেঁচে থাকবেন তিনি। অলস দুপুরে সাদাকালো যুগে ফিরে যেতে যেতে চিরকালের বাঙালি মন কেমন জেগে উঠবে হাল্লার দুষ্টু মন্ত্রী মশাইয়ের জন্য। ছোট্ট সীতাকে বাড়ি চিনিয়ে দেওয়া মুখুজ্জে মশাইয়ের জন্য।