যুগসন্ধির রসিক-কবি ঈশ্বর গুপ্ত

'গুণের ঘাট নেই' কথাটা আর যাই হোক, একটা সুন্দর ছবি তুলে ধরে; যেখানে এমন একটা নদীর কথা বলা হয়, যে-নদীতে গুণের স্রোত বয়ে যায়; যে স্রোত বেয়ে যশের নৌকো ছুটে চলে বল্গাহীনভাবে বৃহতের দিকে; কারণ, সেই নৌকো থামবার মতো কোন ঘাট নেই যে এই নদীতে। নদীটির যেহেতু কোন ঘাট নেই; তাই গুণের প্রবাহমান স্রোতকে ঘাটে নেমে কেউ কলুষিতও করতে পারে না। সুতরাং, 'গুণের ঘাট নেই' কথাটি নিষ্কলুষ ও নিরবচ্ছিন্ন গুণরাশির সুন্দর প্রবাহের ব্যঞ্জনা দেয়। কিন্তু কথাটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হতে হতে তার ভেতরের এই সুন্দর ব্যঞ্জনাটিকেও অসুন্দর করে তুলেছে। কথাটি যদি ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা যেত, তাহলে বলতাম, ঈশ্বর গুপ্তের গুণের কোন ঘাট ছিল না।

আসলে, ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন একাধারে কবি-সাহিত্যিক-গবেষক; অন্যদিকে অকুতোভয় সাংবাদিক। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রায় পাঁচশো বছরের ঐতিহ্য পেরিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। কেননা, তাঁর পূর্ববর্তী বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র রায় অব্দি সাহিত্য ছিল নিতান্তই দেবদেবীর মহিমাকীর্তনের মাধ্যম। ঈশ্বর গুপ্তই প্রথম দেখালেন যে, বাংলা ভাষায় বাংলা কাব্যে অনায়াসেই দেশের কথা দশের কথা অসাধারণভাবে তুলে আনা যায়। তাছাড়া বাংলা ভাষা যে অত্যন্ত সরসতম একটি ভাষা, রসকবিতা রচনা করে তাও তিনি দেখিয়ে দিলেন; দেখিয়ে দিলেন, এ-ভাষায় অত্যন্ত সরসভঙ্গিতে অতীব নিকৃষ্ট জীব পাঁঠার মহিমাকীর্তনও করা যায়, যথা:

"রসভরা রসময় রসের ছাগল।

তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।।...

চাঁদমুকে চাঁপদাড়ি গালে নাই গোঁপ।

শৃঙ্গ খাড়া ছাড়া ছাড়া লোমে লোমে খোপ।।...

ইচ্ছা করে কাঁচা খাই সমুদয় লয়ে।

হাড় শুদ্ধ গিলে ফেলি হাড়গিলে হয়ে।।

মজাদাতা অজা তোর কি লিখিব যশ?

যত চুসী তত খুসী হাড়ে হাড়ে রস।।...

টুকি টাকি টুক টুক মুখে দিই মেটে।

যত পাই তত খাই সাধ নাহি মেটে।।

ঝোলের সহিত দিলে গোটা গোটা আলু।

লক লক লোলো লোলো জিব হয় লালু।।

সাবাস সাবাস রে সাবাসী তোরে অজা।

ত্রিভূবনে তোর কাছে কিছু নাই মজা।।..."

ইংরেজি লবজের সার্থক প্রয়োগ আধুনিক বাংলা কবিতায় যে আকছার দেখা যায়, বাংলা কাব্যে সে কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তই প্রথম দেখিয়েছেন। বাংলা কাব্যে দেশ-বন্দনামূলক কবিতার যে ঐতিহ্য, তাও তাঁর সৃষ্টি। তিনি আঠারো ও উনিশ শতকের যুগসন্ধির প্রতিনিধি কবিই ছিলেন না; তৈরি করেছিলেন নিজস্ব এক কাব্যধারা, নিজস্ব অনুগামী। তাঁর ধারায় অনুগমন করেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও দীনবন্ধু মিত্রের মতো পরবর্তীকালের সাহিত্যরথীদের বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে প্রথম প্রবেশ। ফলত, সাহিত্যের উত্তরাধিকারেও তাঁর অবদান রয়েছে।

বঙ্গদেশে ইংরেজি ভাষায় দৈনিক বা সাময়িক পত্রের প্রকাশ প্রথম ইংরেজের হাতেই ঘটেছিল। তবে বাংলা ভাষার প্রথম সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের কৃতিত্ব ঈশ্বর গুপ্তেরই।সেই পত্রিকার নাম, 'সংবাদ প্রভাকর'। ১২৩৭ বঙ্গাব্দে পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশ পেতে শুরু করে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসাবে। ১২৪৬ বঙ্গাব্দের শুরুতে সপ্তাহে তিন বার এবং পয়লা আষাঢ় থেকে দৈনিক পত্রিকা হিসাবে তা প্রকাশিত হতে শুরু করে।এই পত্রিকার তিনিই সম্পাদক, তিনিই সাংবাদিক, তিনিই লেখক। প্রকৃতপক্ষে তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

 

IshwarChandraGupta

 

বাংলা ভাষায় প্রথম জীবনী সংগ্রহ ও রচনার কৃতিত্বও ঈশ্বর গুপ্তের। বাল্য থেকেই ছন্দ মিলিয়ে ছড়া কাটায় দারুণ দক্ষতা ছিল ঈশ্বরের। কালে কালে জীবনধারণ ও ভালোলাগার জায়গা থেকে একসময় কবিওয়ালাদের দলেও তিনি ভিড়েছিলেন। ফলে, সেই সময় থেকেই এই সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তাঁর অন্তরে তৈরি হয়েছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। সেই শ্রদ্ধার জায়গা থেকেই তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, এই মানুষগুলোর জীবনকথা ভাবীকালের জন্য সঞ্চয় করে রাখা উচিত। তারই ফলে, প্রায় দশ বছর ধরে বহু পরিশ্রমে বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে পূর্বসূরি ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, রামনিধি গুপ্ত, হরু ঠাকুর, রাম বসু, নিতাই দাস প্রভৃতি কবির জীবনকথা সংগ্রহ ও রচনা করে 'সংবাদ প্রভাকর'-এ প্রকাশ করেছিলেন।

ঈশ্বর গুপ্তের মনীষা ছিল, তবে তিনি সংস্কারের গোঁড়ামি থেকে মুক্ত ছিলেন না। তাই সমসময়ের স্ত্রী শিক্ষা, বিধবা বিবাহের প্রবর্তন প্রভৃতি সমাজসংস্কারমূলক কাজকে ভালো চোখে দেখতে পারেননি। সেখান থেকেই সাহিত্যে ব্যঙ্গরস হয়ে উঠেছিল সংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদের হাতিয়ার। তবে, সকলেই যে উদার হবেন তারও তো কোন মানে নেই। বেড়ে ওঠার কালে পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রভাব এক একজনের ওপর এক একরকমভাবে পড়ে। তাঁর মনেও সেভাবেই প্রাচীন সংস্কার এমনভাবে গেঁড়ে বসেছিল যে, তা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পারেননি।

ঈশ্বর গুপ্তের জন্ম কাঁচরাপাড়ায়। ১২১৮ বঙ্গাব্দে। জন্মের অল্পকাল পরেই মাকে হারান তিনি। সংসারে স্বচ্ছলতা ছিল না। তাই পড়াশুনো পাঠশালার বাইরে আর এগোয়নি। অবলম্বন হয় নিদারুণ কষ্টের জীবন। জীবনধারণের প্রয়োজনে কবিয়াল আর পালাগানের দলে ঘুরতে ঘুরতে যখন কৈশোর কাটছিল, তখন বাবা মারা গেলেন। আশ্রিত হলেন মামাবাড়িতে। মামার বাড়ি জোড়াসাঁকোয়। সেখানে সখ্যতা হল ঠাকুরবাড়ির যতীন ঠাকুরের সঙ্গে। তাঁর সাহচর্যেই হলেন স্বশিক্ষিত। তারপর সখার সাহায্যেই কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। এবং ''সংবাদ প্রভাকর"- এরও প্রকাশ ঘটল। সূচিত হল ইতিহাস।

ঈশ্বর গুপ্ত পনের বছর বয়সেই বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু সন্তানাদি হয়নি। তাঁর বংশে উত্তরাধিকারী না-থাকলেও তাঁর জন্য বাংলা সাহিত্য আজও বয়ে চলেছে ঘুরে দাঁড়ানোর উত্তরাধিকার। তবুও আক্ষেপের বিষয়, অনেকগুলি ধারায় পথ-প্রদর্শক হয়েও ঈশ্বর গুপ্ত মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুর পর থেকেই আজ ক্রমশ বিস্মৃত। এ-ব্যপারে মহাকবি মধুসূদন ঈশ্বরের নামাঙ্কিত সনেটে সেই কবেই আক্ষেপ করেছেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক:

                  "...দৈব-বিড়ম্বনে

ঘটিল কি সেই দশা সুবঙ্গ-মঙ্গলে

তোমার কোবিদ বৈদ্য! এই ভাবি মনে

নাহি কি যে কেহ তব বান্ধবের দলে,

তব চিতা-ভস্মরাশি কুড়ায়ে যতনে,

স্নেহ-শিল্পে গড়ি মঠ, রাখে তার তলে?"

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...