সুর-সাহিত্য আর বিবি

বাবা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশের প্রথম আইপিএস। মা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বাঙালী মেয়েদের ভাবনায় এনেছিলেন নতুন আলোর ছোঁয়া। কাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এহেন যাঁর পারিবারিক পরিমন্ডল, তিনি যে অন্য আলোর মানুষ হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। মানুষটির নাম ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, ওরফে বিবি।

ছোটবেলা থেকেই সুর-সাহিত্য আর বিবি, তিন মিলে একাকার। রবি ছায়ার বড় হয়ে ওঠা। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁকে পড়ে শোনাতেন হেলেনস বেবি, লুই ক্যারল। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘সিমলা থেকে নেমে এসে সেই যে বছর আষ্টেক বয়সের পর কলকাতার স্কুলে ভর্তি হলুম তখন থেকে প্রায় তার জীবনান্ত পর্যন্ত রবিকাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব আমাদের সাহিত্যজীবনকে গড়ে তুলেছিল, এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য। সে ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত আমরা যা কিছু করেছি, হয়েছি, এমনকি ভেবেছি, পর্যন্ত তা তার ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আচ্ছন্ন।’

ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের খুব কাছের ছিলেন তিনি। বিশেষ করে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই ছেলেমেয়ের। বিবি আর সুরেন।

ছোটবেলায় সেতার, পিয়ানো আর বেহালা শিখতেন। সঙ্গে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। ফরাসী ভাষার প্রতি অসম্ভব টান ছিল। লা মার্টিনিয়র স্কুলের এক শিক্ষিকার কাছে ফরাসী শিখতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ খুব উৎসাহ দিতেন প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীকে।

devi and

অনুবাদের কাজে টান তৈরি হয়েছিল কাঁচাবেলা থেকেই। কিশোরী বয়সে ‘বালক পত্রিকা’য় রাস্কিনের রচনার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। নে গ্রুসের ভারতবর্ষ, পিয়ের লোতির কমল কুমারিকাশ্রম এবং মাদাম লেভির ভারতভ্রমণের কাহিনী বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে সহজ করে তোলার উদ্দ্যেশ্যেই ছিল অনুবাদ। ব্যক্তিগত আগ্রহে অনুবাদ হলেও সাহিত্যিক মূল্য কম নয়।

পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ভূমিকা ফরাসী থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায়।

‘জাপানযাত্রী’-এর মতো বহু লেখার অনুবাদ তিনি করেছিলেন। সে সমস্ত অনুবাদ কর্মের প্রশংসাও করেছিলেন কবি।
ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ রবীন্দ্রগানের স্বরলিপি নির্মাণ। মহিলাদের সঙ্গীত সঙ্ঘের মুখপত্র ‘আনন্দ সঙ্গীত’ পত্রিকার তিনি অন্যতম যুগ্ম সম্পাদিকা ছিলেন। স্বামী প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে মিলিতভাবে লিখেছিলেন ‘হিন্দু সঙ্গীত’। তাঁর নিজের লেখা গান স্বরলিপিসহ ‘সুরঙ্গমা পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৫৬ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের বাইরেও তাঁর মৌলিক কাজের পরিসরের ব্যাপ্তি সমুদ্র মাপের। শিক্ষা-সাহিত্য-সঙ্গীত থেকে শুরু করে সামাজিক কাজ সবেতেই রেখেছেন নিজস্ব স্বাক্ষর। আগামী প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রচর্চাকে আগ্রহী করে তুলতে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী ছিলেন নিরলস। গান হোক বা সাহিত্য সবখানেই, তিনি অভিধান-ব্যক্তিত্ব।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...